ধরণী সামন্ত, আমি এবং ...

 ধরণী সামন্ত, আমি এবং ...

     

    এটা ধরণী সামন্তর গল্প নয় , হলে শোক সভায় অত লোকের মাঝে আমি অমন চিৎকার করে ব্যাপারটা ঘটাতে পারতাম না , কিছুতেই না । 

          হ্যাঁ, শোকসভায় অনেক লোকের মাঝেই আমি ব্যাপারটা ঘটিয়েছিলাম। তাতে শোক সভার সুরটা হয়তো একটু কেটে গিয়েছিল কিন্তু তার জন্য আমার বিন্দুমাত্র অনুতাপ  ছিল না , কেননা আমার মনে হয়েছিল অনেকেরই সেই শোকসভায় হাজির থাকার অধিকার ছিলনা । কোথা থেকে এতো ক্রোধ আমার ভেতরে জমা হয়েছিল কে জানে । ! সেই ঘটনার পর কি হয়েছিল আমার মনে নেই কেউ আমার বেয়াদবির জন্য দুএকটা চড় চাপড় কষিয়েছিল কিনা তাও মনে নেই । শুধু মনে ছিল একটা আচ্ছন্ন বিধ্বস্ত মানুষের মত শোকসভা রহেকে চলে এসেছিলাম যেন এইমাত্র আমার সর্বস্ব লুট হয়ে গেছে কোন দস্যুর হাতে । আমি বসার ঘরে অনেকক্ষণ সেই ছবিটার দিকে তাকিয়েছিলাম। বিসর্জনের গোবিন্দমাণিক্য । আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম গোবিন্দমাণিক্যর চরিত্রে ধরণীদার সেই অসাধারণ সংলাপ

দাঁড়াইয়া মুখোমুখি দুইভাই হানে

ভাতৃবক্ষ লক্ষ্য করে মৃত্যুমুখি ছুরি

রাজ্যের মঙ্গল হবে তাহে? রাজ্যেশুধু

সিংহাসন আছে গৃহস্থের ঘর নেই,

ভাই নেই, ভাতৃবন্ধন নেই হেথা ?

          শোকসভায় কেউ জোরে কথা বলে না । আমি কিন্তু চিৎকার করেই কথাগুলো বলেছিলাম । তখন সবেমাত্র ছবিতে মালা দিয়ে স্মৃতিচারণ সুরু করেছেন এ তল্লাটের বেশ কেউকেটা লোক নটবর মিত্র যাকে নুটু মিত্তির নামেই লোকে চেনে বেশি । নুটু মিত্তির বলছিল যখন আমি এই ভাঙা মঞ্চটাকে বাঁচাতে একটা হিল্লে করলাম, ঠিক তখনই ধরণীদা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেনকি হিল্লে করার ব্যবস্থা নুটু মিত্তির করেছিল তা আমি জানতাম, কারণ সেই রাতে নুটুর সঙ্গে সব কথাবার্তার একমাত্র সাক্ষি ছিলাম আমি । পাশের ঘরে বসে সব কথাই আমি শুনেছিলাম ।

          শোক সভাটা ছিল ধরণী সামন্তর স্মৃতিতে । নাটিক ও থিয়েটার বলতে এ তল্লাটে যে মানুষটির নাম একবাক্যে সবাই বলেন, তিনি ধরণী সামন্ত । আজ প্রায় বিশ পঁচিশ বছর তাঁকে মঞ্চে দেখা না গেলে কি হবে তিনি ধরণী সামন্ত, এ তল্লাটে থিয়েটারের শেষ কথা । সেই ধরণী সামন্ত চলে গেলেন রবিবার ভোর রাতে । সকালে সবে চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছি । ধরণীদার বাড়ি থেকে আয়া মেয়েটির ফোন দাদা, জেঠু আর নেই, তাড়াতাড়ি চলে এসো

          ধরণীদার মৃত্যু অনেকের কাছেই বিচলিত হওয়ার মত কোন খবর ছিল না । একটা থিয়েটারের লোক চলে গেলে কার কি এসে যায় ! ! ধরণীদা তো সমাজের কেউকেটা ছিল না আমার এখনই যেতে ইচ্ছে করল না । কেননা আমি তো জানি, এখন ধরণীদার দেহটা নিয়ে কামড়াকামড়ি হবে কে কত কাছের লোক ছিল সেই নাটকের মহড়া চলবে নকল কান্নায় । এরকম নকল কান্নার সাক্ষি ছিলাম বৌদি চলে যাবার পর । ধরণীদা বলেছিলেন কেউ মনে রাখেনা রে ! তোর বৌদিকে ছাড়া আমি কি ধরণী সামন্ত হতে পারতাম ? হতে পারতো এই অর্ধেন্দু মঞ্চটা ?

          সেই কবে কলকাতার হাটখোলা থেকে ঠিলানা বদল করে এই লোহালক্কড় আর সিমেন্ট  কারবারীদের এই মুলুকে বাসা বেঁধেছিলেন ধরণীদা বেশি বেশি থিয়েটার কবেন বলে । এবং কি আশ্চর্য, কলকাতা কর্পোরেশনের একশদশ-একশআশির কেরাণী তিন চারজন বন্ধু জোগাড় করে, বৌদির গয়নাগাটি বিক্রি করে সস্তায় একখন্ড জমি কিনে একটা নাট্যমঞ্চও বানিয়ে ফেললেন । নাম দিলেন অর্ধেন্দু শেখর মঞ্চধরণীদা বলতেন দেখ, রবীন্দ্র অহিন্দ্র- শিশির- গিরিশ সকলের নামে থিয়েটার হয়েছে, আর যে মানুষটা থিয়েটারকে জমিদারবাবুদের বৈঠকখানা থেকে আমাদের সকলের কাছে নিয়ে এলো তার নামে কোন মঞ্চ হল নাথিয়েটার করার জন্য অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফিরা তখনকার ইংরাজ সরকারের কত লাঞ্ছনা ভোগ করেছিলেন সেইসব গল্প, ‘নীলদর্পণএর গল্প ধরণীদর কাছ থেকেই শুনেছিলাম । আর ধরণীদাও তো থিয়েটার না করতে পারার যন্ত্রণা নিয়েই চলে গেলেন ! এখন যারা ধরণীদার দেহটাকে নিয়ে কামড়া-কামড়ি করবে তাদের কাছে থিয়েটার মানে নাচন-কোদন ছাড়া আর কি ?

          এইসব ছবি দেখতে দেখতে কখন সেই বাড়িটার সামনে চলে এসেছিলাম খেয়াল ছিল না । ততক্ষণে ধরণীদার দেহটার দখল নিয়ে নিয়েছে পাড়ার কেষ্ট-বিষ্টুরা । আর আমি কাল সন্ধ্যাতেও ঐ বাড়িটায় এসেছিলাম, এখন একা, ভীষণ একা । একসময় নাটক করতেন, ধরণীদার হাতে গড়া অনেকেই এলেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে মৃদু কথা-বার্তা চালাচ্ছিলেন । আমি নিশ্চিত তাঁরা এখনও সেই কবে ঘী খাওয়া আঙুলের ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন । আহা, যদি আমার কাছে একটা আয়না থাকতো ! নুটু মিত্তিরও চলে এসেছিলো এবং যথারীতি কানে মোবাইল গুঁজে চেলা-চামুন্ডা পরিবৃত হয়ে নিজেকে জানান দিচ্ছিলো । দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমি মুখে আসা একদলা থুতু ফেলে দাড়িয়েই থাকলাম ।

          বছর দুয়েক আগে ধরণীদা একবার শেষ চেষ্টা করেছিলেন এই নুটু মিত্তির কে ধরে যদি কিছু সরকারী সাহায্য পাওয়া যায়, মঞ্চটা বাঁচে । বলেছিলেন, ‘নুটু তোমার তো সরকারী মহলে অনেক জানাশোনা । পাড়ার ফুটবল ক্লাবের জন্য অনুদান আদায় করে দিলে আর চল্লিশ বছরের মঞ্চটাকে বাঁচানোর জন্য কিছু করবে না ?

          সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নুটু বলেছিল না না ধরণীদা , শুধু নাচন-কোদনের জন্য সরকারী অনুদান পাওয়া যাবে না । আপনাকে তো বলেছিলাম , ওটা দিয়ে দিন , কমিউনিটি হল বানানোর ব্যবস্থা করবো, সভা, সেমিনারও হবে আপনারা নাটক-ফাটকও করবেন । কেন মড়া আগলে বসে আছেন ধরণীদাআর একমুহুর্ত না থেকে ধরণীদা আমাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন । সেই নুটু মিত্তির এখন ধরণীদার দেহ আগলে শেষযাত্রার তদারকি করছে । মনে মনে বলেছিলাম নেই তাই খাচ্ছো, থাকলে কোথায় পেতে’ ?

          নুটু মিত্তিররা বোধয় কার দিন শেষ হয়ে আসছে তার একটা আগাম গন্ধ পায় । ধরণীদা মারা যাবার আগের দিন অসুস্থ মানুষটাকে দেখতে ধরণীদার বাড়ি এসেছিল । বলেছিল এবার আপনার অর্ধেব্দু শেখর নঞ্চের একটা হিল্লে হবে ধরণীদা, আপনি শুধু একটা সম্মতি দিন , কাগজপত্র সব রেডি করে রেখেছি 

          এই ছবিটাও সরে গেল নুটু মিত্তিরের গলার শব্দে। কাকে যেন বললো শোন, গাড়ি বলে দিয়েছি, এখনই চলে আসবে, বডি নিয়ে সোজা নীলরতনে চলে যাবেকে একজন বলল, ‘ অর্ধেন্দু মঞ্চের সামনে একটু দাঁড়াবে না নুটুদা’ ? নিজের হাতে গড়া মঞ্চে যেতেও ধরণীদাকে নুটু মিত্তিরের অনুমতি নিতে হচ্ছে । বললো, ‘আবার ওখানে বডি বানাবি ? ঠিক আছে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিবি না কিন্তু , আর শোন আমি চললাম, আমার আবার থানায় একটা মিটিং আছে

          চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল ময়লা হাতে লোকটা তোমার পবিত্র দেহ ছুতে চাইছে ধরণীদা, ওকে ছুঁতে দিও না । কিন্তু  বলতে পারলামনা , বলার সাহস পেলাম না ।

          এবং কি আশ্চর্য, সেদিন ধরণীদার শোক সভায় সেই সাহসটা পেয়ে গেলাম । বোধয় আমার ওপর ধরণীদা ভর করেছিল সেদিন । 

          শোকসভা শুরু হয়েছে শোক প্রস্তাব পড়া হয়েছে , আমি কিছুই শুনিনি । সকলের শেষে একটা কোণে দাড়িয়েছিলাম ধরণীদার ছবিটার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে । সঞ্চালকের কাঁপা কন্ঠ বললো এবার স্মৃতিচারণ করবেন এলাকার সুপরিচিত সমাজকর্মী ও শিল্প-সংস্কৃতির বিদগ্ধ পৃষ্ঠপোষক মাননীয় নটবর মিত্র মহাশয়

          ধরণীদার ছবিতে একটা মালা লটকে দিয়ে নুটু মিত্তির বলতে শুরু করলো । জানালো আজকের এই শোকসভাতে আমি একটা আনন্দ সংবাদ দিতে চাই । আমি ভাগ্যবান, কারণ আমার সঙ্গেই ধরণীদা শেষ কথা বলেছেন নাটক আর মঞ্চ নিয়ে । গতকালই উনি সম্মত হয়েছেন । এই অর্ধেন্দু মঞ্চের জমিতে তৈরী হবে একটা কমিউনিটি হল । ধরণীদার স্বপ্ন সার্থক হবেআর এই সময়েই আমি প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম মিথ্যে কথা । এই লোকটাই ধরণীদাকে আরো কিছুদিন বাঁচতে দিল না , ধরণীদা গো , কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল এই ফেরেববাজ দের মুলুকে এসে থিয়েটার করতে ?’ কে একজন এসে আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বললো কাকে কি বলছিস খেয়াল আছে ? 

          খেয়াল ছিল বৈকি ! কাল রাতে নুটু মিত্তির যখন অর্ধেন্দু মঞ্চের জমিতে কমিউনিটি হল বানানোর সম্মতি চাইছিল তখন ধরণীদা বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ আমার নিশ্বাস পড়বে ততক্ষণ তো পারবে না নুটু । নিশ্বাস বন্ধ হলে দেহটাকে নীলরতনে পুরে দিয়ে মঞ্চটাকে খাবলে খুবলে খেয়ো, তার আগে নয়আমি তখন পাশের ঘরে, রাতের আয়া মেয়েটার আসার অপেক্ষায় । চলে আসার আগে ধরণীদা শেষ কথা বলেছিলেন তোরাও আর মঞ্চটাকে বাঁচাতে পারবি না রে, শকুনের দল বড় মরিয়া হয়ে উঠেছে

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ১৬

  অন্য ধারার গান : গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী     গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীতধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কা...