শেষ ইচ্ছে

 শেষ ইচ্ছে

অমিত বোধহয় বুঝেছিল এই ধাক্কাটা সুধীরেন্দ্র আর শেষ পর্যন্ত সামলে উঠতে পারবেন না । জিজ্ঞাসা করলো, ‘জেঠু অনির্বাণদাকে আসতে বলবো ? আমি তো নেট ব্যবহা করিআমাকে ফোন নম্বরটা জানালে ফোনও করতে পারি । বলবো জেঠু’ ? অমিত ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞাসা করেছিল কথাটা । ও জানতো সুধীরেন্দ্র তার আমেরিকায় থাকা ছেলে অনির্বাণের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চান না । তবু, একমাত্র ছেলে তো !

 

চোখ খুলে এক প্রশান্ত চাউনি সুধীরেন্দ্রর । প্রশান্ত, কিন্তু কঠিন । স্পষ্ট উচ্চারণে সুধীরেন্দ্র বললেন, ‘তোর কি খুব অসুবিধা হচ্ছে অমিত রোজ রোজ আসতে ? আমি তো তোকে বলিনি রোজ রোজ আসতেআর কিছু বলার ছিল না অমিতের । এমনই সুধীরেন্দ্র সান্যাল । নামি অভিনেতা, মধ্যম গ্রামের  এ তল্লাটে এক ডাকে সবাই চেনে । খুব শ্রদ্ধেয় মানুষ । অমিতকে খুব ভালোবাসেন । মনে আছে অমিতের, সুধীরেন্দ্র তাকে বলেছিলেন দেখ থিয়েটারকে যদি ভালোবাসতে পারিস তবেই থিয়েটারে আসবি । থিয়েটার থেকে টাকা পয়সা উপার্জনের কথা যদি ভাবিস তাহলে আসিসনি । সুধীরেন্দ্রর হাত ধরেই আমিতের থিয়েটারে আসা । আজ নাট্যাভিনেতা অমিত গাঙ্গুলী্র যেটুকু খ্যাতি তা সুধীরেন্দ্র জেঠুর জন্যই, এটা অমিত সব সময়েই স্বীকার করে । সুধীরেন্দ্রও তাকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসেন ।

 

প্রতিদিন সন্ধ্যায় রিহার্শালে যাবার আগে ঘন্টাখানেক জেঠুর সঙ্গে কাটিয়ে যেতো । নানান কথা । বড় বড় অভিনেতাদের জীবন কথা । শেষ জীবনে থিয়েটার করতে না পারায় শিশিরকুমার ভাদুড়ীর নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা জেঠুই তাকে বলেছিল । বলেছিল কোন অভিমানে শম্ভূমিত্র তার শেষ ইচ্ছাপত্রে লিখে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃতদেহ যেন সোজা স্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর অনুরাগীদের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ না দিয়ে ।  এইসব কথা ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল অমিত । কছুটা চমকে উঠলো সুধীরেন্দ্রর কথায় । সোমেশকে একবার আসতে বলবি অমিত ? সোমেশ চ্যাটার্জী, নামি এডভোকেট । সোমেশ আগেও একদিন এসেছিল কি সব কাগজ-পত্র নিয়ে । বোধয় উইল করতে চান সুধীরেন্দ্র । অমিত ভেবে পায়না, উইল করতে হবে কেন ? একটাই তো ছেলে, বাবার মৃত্যুর পর স্বাভাবিক নিয়মে সেইইতো উত্তরাধিকারী । তবে ? তবে কি অন্য কিছু ভেবেছেন সুধীরেন্দ্র ? বললো ঠিক আছে, কাল আসতে বলবসুধীরেন্দ্র তাকে থামিয়ে বলল কাল নয় রে, আজ সন্ধ্যাতেই আসতে বল, সময় বেশি নেই । তারপর ধীরে ধিরে বললেন, ‘তুই এখন যা অমিত । তোর তো, আজ রবিবার, দুবেলাই রিহার্শাল । যাবার পথে সোমেশকে খবর দিয়ে যাবি’, আজ সন্ধ্যাতেই আসতে বলবি । কাজের মেয়েটা এসে গেছে অনেকক্ষণ, অমিত ওঠে ।  যাবার সময় বলে আজ সন্ধ্যায় আসতে একটু  দেরি হবে জেঠু, বিকেল চারটে থেকে ফুল রিহার্শাল আছে তো

 

দুবছর আগে স্ত্রী সীমা মারা যাবার পর থেকেই নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিতে শুরু করেন সুধীরেন্দ্র । প্রিয় নাটকের দল থেকে সরে এসেছেন একবছর হল । একটু জোরাজুরি করলে হয়তো থেকে যেতেন । ওরা বলেনি । বয়সে অনেক ছোট প্রদ্যোৎ বলেছিল বৌদি মারা যাবার পর আপনি একটু অমনোযোগী হয়ে গেছেন সুধীদা । নতুন নাট্যভাবনার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন নাপ্রদ্যোৎরা একটা সম্বর্ধনার আয়োজন করেছিল  সুধীরেন্দ্র না করে দিয়েছিল । তাতে অবশ্য অমিতের কোন এদিক-সেদিক হয়নি । সুধীরেন্দ্র যেদিন বিছানা নিল সেদিন সকালে কাজের মেয়েটাই অমিতকে খবর দিয়েছিল । ছুটে গিয়েছিল অমিত । বাথরুম যাওয়ার সময় পড়ে গেছেন । দিনের বেলা বলেই খবরটা সময়মত পেলো । রাত্রে হলে তো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়টুকুও পেত না । দিন পাঁচেক পরেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল । শরীরের ডানদিকটা অবশ হয়ে আসছে । এখন বাড়িতেই বিছানায় শুয়ে থাকা, ওষুধগুলো নিয়মিত খাওয়া । প্রায় একমাস এই অবস্থায় । একজন আয়া আর রাত্রে থাকার জন্য একজন ছেলেকে ঠিক করে দিয়েছে অমিতই । সারাক্ষণ সুধীরেন্দ্রর কাছে একজন থাকা দরকার । ডাক্তার বলে  দিয়েছিলেন ।

 

হাসপাতাল থেকে ফিরে একটু সুস্থ্য হওয়ার পর অমিত একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল জেঠু, অনির্বাণদাকে একটা খবর দিতে হবে তোসুধীরেন্দ্র বলেছিল না, আমি চাই না আমার সঙ্গে ওর আর দেখা হোক । ঐ নামটা আর আমার সামনে উচ্চারণ করিস নাঅমিত ভাবার চেষ্টা করে বাবার মনে তার ছেলে সম্পর্কে কতখানি ক্রোধ জমলে এমন কথা কেউ বলতে পারে । অমিত অবশ্য তার জেঠুর কোন দোষ দেখে না বিয়ের একমাস পরেই অনির্বাণ সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকায় চলে গেল। পনেরো বছরে একদিনের জন্যেও বাবা মার সঙ্গে দেখা করতে এলো না । সীমা চায়নি, ছেলে বিদেশে যাক । অনির্বাণ বলেছিল মাত্র তিন বছর তো মাতিন বছর পরেই ফিরে আসবো । এখন তো দূরত্বটা কোন ব্যাপারই নাএকটা ওয়েবক্যাম কিনে কি করে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে তাও শিখিয়ে দিয়েছিল বাবাকে ।

 

অনেকগুলো তিন বছরপেরিয়ে গেল, এলো না। সুধীরেন্দ্র বুঝতে পেরেছিল, ছেলে আর ফিরবে না । একবার বাবা-মাকে মাসখানেকের জন্য তার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সুধীরেন্দ্র সম্মত হননি । তবু ভেবেছিল সুধীরেন্দ্র, মায়ের শেষ শয্যার খবর পেয়ে কিংবা জননীর মৃতমুখটা শেষ দেখার জন্য একবার আসবে । মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে সীমার জড়িয়ে আসা কন্ঠে খোকা কখন আসবে ? আসবে না’ ? অনির্বাণ আসেনি । সীমার নিথর দেহটা ছেলের আসার অপেক্ষায় ঠান্ডাঘরে রাখা ছিল একদিন । সে এলোনা, একটা ফোন এলো, ‘যাওয়া যাচ্ছে না বাবা, কাজের ভীষণ চাপ, ছাড়া পাচ্ছি না। তোমরা ক্রিয়া-কর্মটা ভালো করে করে নাও । আমি কদিন পরেই যাওয়ার চেষ্টা করছিহৃদয় বোধয় ছিঁড়ে গিয়েছিল সুধীরেন্দ্রর কথাটা বলতে । বলেছিল না এলেই খুশি হবোআর একটা কথাও বলেননি । সীমার পারলৌকিক ক্রিয়া-কর্ম মিটে যাবার পর একবার মাত্র ফোনে বলেছিল ছেলেকে । একেবারে বিক্রি হয়ে গেলি রে’ ! ক্রোধ নয়, হাহাকার । হয়তো সুধীরেন্দ্র জানতো,এরকমই হওয়ার ছিল । সেই শেষ কথা ছেলের সঙ্গে। টেলিফোনটাও জমা করে দিয়েছিলেন টেলিফোন অফিসে গিয়ে ।

 

যেদিন অনির্বাণ সুধীরেন্দ্রকে বলেছিল যে কোম্পানী তাকে আমেরিকায় তাদের হেড অফিসে জয়েন করতে বলছে, তিন বছর থাকতে হবে । সেদিন কি সুধীরেন্দ্র বুঝতে পারেন নি ? পেরেছিলেন বলেই আজকের এই হাহাকার ! সীমা চাননি, সুধীরেন্দ্রও মন থেকে চাননি, কিন্তু বুঝেছিলেন কিছুই তার করার নেই । সময়কে রুখে দেবার ক্ষমতা তাঁর নেই । অনির্বাণ বলেছিল দেখো বাবা, পৃথবীটা এখন খুব ছোট হয়ে গেছে । তোমাদের পুরনো ধ্যান-ধারণগুলো পালটে যাচ্ছে

 

সুধীরেন্দ্র ভেবে পায় না, কবে, কেমন করে সব পালটে গেল ! পিতা-মাতার স্নেহ, ভালোবাসা, আকাঙ্খা এগুলোও কি পালটে যায় ? হয়তো যায় । হয়তো আরো কত কি পালটে যাবে । অমিত একদিন বোকার মত জিজ্ঞাসা করেছিল, জেঠু এখনকার আমরা কেন এমন বদলে যাচ্ছি ? সুধীরেন্দ্র বলেছিল রক্তকরবী নাটকটা দেখেছিস তো । সেই সংলাপটা মনে আছে ? অধ্যাপক নন্দিনীকে বলছে আমরা যে মরা ধনের শবসাধনা করি । তার প্রেতকে বস করতে চাই । সোনার তালের তাল-বেতালকে বাঁধতে পারলে পৃথিবীকে পাব মুঠোর মধ্যেআমিত আর কিছু বলেনি ।  সোনার তাল-বেতালকে বেঁধে ফেলার বাসনা কি আর তিন বছরে মেটে ? মেটেনি ১৫ বছরেও । সুধীরেন্দ্র বুঝে ছিলেন। ছেলে তাঁর ফিরে আসবে এমন আশাকে প্রশ্রয় দেয়নি বছর তিনেক কেটে যাবার পর থেকে ।

 

সন্ধ্যার রিহার্শাল আর শেষ করা গেলো না । রাত্রি আটটা নাগাদ কাজের মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে এলো । শিগগির চলো অমিত দা, জেঠু কেমন করছে । এক্ষুনি তোমাকে ডাকতে বললোউকিল বাবুও এসেছেএক নিঃশ্বাসে বলে গেলো কথাটা । অমিত চমকে উঠলোরিহার্শাল বন্ধ করে তাকে যেতে বলার লোক তো জেঠু নয় ! তবে ? আশঙ্কায় ডুবে গেলো অমিত । বললো তুই যা আমরা যাচ্ছি

 

রিহার্শাল বন্ধ করে দলের সবাই চলে এলো । পাড়ার দুএকজনও এসেছে দেখলো । আর এক বয়স্ক মানুষকে দেখলো । অমিত খুব একটা চেনে না। তবে দিন দশেক আগে একবার সূধীরেন্দ্রর কাছে আসতে দেখেছিল । দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বারাসাত শহরে দীননাথ একটা বৃদ্ধাশ্রম চালায় শুনেছে । বাড়তি কৌতুহল অমিতের কোনদিনই নেই, সেদিনও কোন কৌতুহল প্রকাশ করেনি ।  ওদের একজন বললেন ডাক্তার ব্যানার্জীকে খবর দিয়েছি, উনি এখনই আসছেনশ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে সুধীরেন্দ্রর। তারমধ্যেই তাকালেন উদ্বিগ্ন মুখগুলোর দিকে । ধীর কন্ঠে বললেন তোরা এসেছিস’? সোমেশ উকিলকে বললেন কাগজদুটো দাওকাঁপা হাতে কাগজদুটো হাতে নিলেন সুধীরেন্দ্র, হাতটা এগিয়ে দিয়ে কলমটা চাইলেন । সোমেশ কলমটা হাতে ধরিয়ে দিলেন । সোমেশ বললেন একবার পড়ে দেবো না’ ? সোমেশকে থামিয়ে ক্ষিণ কন্ঠে সুধীরেন্দ্র বললেন সই করার পর অমিত বয়ানটা পড়ে দিবিসুধীরেন্দ্র কাগজদুটো সই করে, দলিলের মত দেখতে কাগজটা সেই দীননাথের হাতে দিলেন আর একটা অমিতকে ফেরত দিলেন পড়বার জন্য । অমিত অপলক চোখে কাগজটাতে চোখ বোলাল । পড়া আর হল না। সুধীরেন্দ্র নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না, মুখটা ফাঁক করে টানছেন শেষ হাওয়াটা যতটুকু শুষে নেওয়া যায় ! দুতিনবার টেনে থেমে গেলেন । ডাক্তার ব্যানার্জী সুধীরেন্দ্রর বুকে স্টেথস্কোপ ধরে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন যেন অপেক্ষা করছেন শেষ স্পন্দনটা শোনার জন্য। স্টেথোটা কান থেকে খুলে শুধু বললেন শেষঅমিত তখনো সোমেশ উকিলের কাগজটা যেটা একটু আগে সুধীরেন্দ্র তাকে দিলেন পড়বার জন্য অপলক তাকিয়ে আছে । কেউ জানতে চাইলো না, কি লেখা আছে । শুধু অমিত জানলো । লেখা আছে

 

আমি, সুধীরেন্দ্র সান্যাল স্বজ্ঞানে, ও পূর্ণ সচেতনতায় এই ইচ্ছাপত্র স্বাক্ষর করছি যে

() আমার মৃত্যুর পর আমার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ওপর আমার আমেরিকা প্রবাসী একমাত্র পুত্র অনির্বাণ সান্যালের বা অন্য কারোর  কোন আইনী অধিকার বর্তাবে না ।

() আমার বাসভবন ও তৎসংলগ্ন জমিতে গড়ে উঠবে সীমা স্নেহচ্ছায়ানামে এক বৃদ্ধাশ্রম, যেটি গড়ে তুলবেন বারাসাত নিবাসী শ্রী দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায় । এই উদ্দেশ্যে শ্রী দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে একটি পৃথক দানপত্রও সজ্ঞানে আজকের তারিখে স্বাক্ষর করেছি ।

() স্থানীয় একটি মাত্র ব্যাঙ্কে সঞ্চিত নগদ অর্থ উক্ত সীমা স্নেহচ্ছায়াগঠন ও পরিচালনার কাজে শ্রী দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে ব্যয়িত হবে ।

() শ্রী সোমেশ চ্যাটার্জী, এডভোকেট , এই ইচ্ছাপত্র ও শ্রী দীননাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে আমার স্বাক্ষরিত দানপত্রে্র নকল, জন্মসূত্রে আমার পুত্র, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী, শ্রী অনির্বাণ সান্যালের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন ।

 

সব শেষ । অমিত অপলক তাকিয়ে সুধীরেন্দ্রর নিথর দেহটার দিকে । সন্বিত ফিরলো সোমেশের কথায় । সাক্ষির সইটা করে দাওপেনটা বাড়িয়ে দিলেন সোমেশ । সই করলো । ওদের দলেরই একজন ফোন করে দিয়েছে নীলরতন সরকার হাসপাতালে । গাড়ি আসবে, দানকরা সুধীরেন্দ্রর দেহটা চলে যাবে নীলরতনে ।

 

ধরণী সামন্ত, আমি এবং ...

 ধরণী সামন্ত, আমি এবং ...

     

    এটা ধরণী সামন্তর গল্প নয় , হলে শোক সভায় অত লোকের মাঝে আমি অমন চিৎকার করে ব্যাপারটা ঘটাতে পারতাম না , কিছুতেই না । 

          হ্যাঁ, শোকসভায় অনেক লোকের মাঝেই আমি ব্যাপারটা ঘটিয়েছিলাম। তাতে শোক সভার সুরটা হয়তো একটু কেটে গিয়েছিল কিন্তু তার জন্য আমার বিন্দুমাত্র অনুতাপ  ছিল না , কেননা আমার মনে হয়েছিল অনেকেরই সেই শোকসভায় হাজির থাকার অধিকার ছিলনা । কোথা থেকে এতো ক্রোধ আমার ভেতরে জমা হয়েছিল কে জানে । ! সেই ঘটনার পর কি হয়েছিল আমার মনে নেই কেউ আমার বেয়াদবির জন্য দুএকটা চড় চাপড় কষিয়েছিল কিনা তাও মনে নেই । শুধু মনে ছিল একটা আচ্ছন্ন বিধ্বস্ত মানুষের মত শোকসভা রহেকে চলে এসেছিলাম যেন এইমাত্র আমার সর্বস্ব লুট হয়ে গেছে কোন দস্যুর হাতে । আমি বসার ঘরে অনেকক্ষণ সেই ছবিটার দিকে তাকিয়েছিলাম। বিসর্জনের গোবিন্দমাণিক্য । আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম গোবিন্দমাণিক্যর চরিত্রে ধরণীদার সেই অসাধারণ সংলাপ

দাঁড়াইয়া মুখোমুখি দুইভাই হানে

ভাতৃবক্ষ লক্ষ্য করে মৃত্যুমুখি ছুরি

রাজ্যের মঙ্গল হবে তাহে? রাজ্যেশুধু

সিংহাসন আছে গৃহস্থের ঘর নেই,

ভাই নেই, ভাতৃবন্ধন নেই হেথা ?

          শোকসভায় কেউ জোরে কথা বলে না । আমি কিন্তু চিৎকার করেই কথাগুলো বলেছিলাম । তখন সবেমাত্র ছবিতে মালা দিয়ে স্মৃতিচারণ সুরু করেছেন এ তল্লাটের বেশ কেউকেটা লোক নটবর মিত্র যাকে নুটু মিত্তির নামেই লোকে চেনে বেশি । নুটু মিত্তির বলছিল যখন আমি এই ভাঙা মঞ্চটাকে বাঁচাতে একটা হিল্লে করলাম, ঠিক তখনই ধরণীদা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেনকি হিল্লে করার ব্যবস্থা নুটু মিত্তির করেছিল তা আমি জানতাম, কারণ সেই রাতে নুটুর সঙ্গে সব কথাবার্তার একমাত্র সাক্ষি ছিলাম আমি । পাশের ঘরে বসে সব কথাই আমি শুনেছিলাম ।

          শোক সভাটা ছিল ধরণী সামন্তর স্মৃতিতে । নাটিক ও থিয়েটার বলতে এ তল্লাটে যে মানুষটির নাম একবাক্যে সবাই বলেন, তিনি ধরণী সামন্ত । আজ প্রায় বিশ পঁচিশ বছর তাঁকে মঞ্চে দেখা না গেলে কি হবে তিনি ধরণী সামন্ত, এ তল্লাটে থিয়েটারের শেষ কথা । সেই ধরণী সামন্ত চলে গেলেন রবিবার ভোর রাতে । সকালে সবে চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছি । ধরণীদার বাড়ি থেকে আয়া মেয়েটির ফোন দাদা, জেঠু আর নেই, তাড়াতাড়ি চলে এসো

          ধরণীদার মৃত্যু অনেকের কাছেই বিচলিত হওয়ার মত কোন খবর ছিল না । একটা থিয়েটারের লোক চলে গেলে কার কি এসে যায় ! ! ধরণীদা তো সমাজের কেউকেটা ছিল না আমার এখনই যেতে ইচ্ছে করল না । কেননা আমি তো জানি, এখন ধরণীদার দেহটা নিয়ে কামড়াকামড়ি হবে কে কত কাছের লোক ছিল সেই নাটকের মহড়া চলবে নকল কান্নায় । এরকম নকল কান্নার সাক্ষি ছিলাম বৌদি চলে যাবার পর । ধরণীদা বলেছিলেন কেউ মনে রাখেনা রে ! তোর বৌদিকে ছাড়া আমি কি ধরণী সামন্ত হতে পারতাম ? হতে পারতো এই অর্ধেন্দু মঞ্চটা ?

          সেই কবে কলকাতার হাটখোলা থেকে ঠিলানা বদল করে এই লোহালক্কড় আর সিমেন্ট  কারবারীদের এই মুলুকে বাসা বেঁধেছিলেন ধরণীদা বেশি বেশি থিয়েটার কবেন বলে । এবং কি আশ্চর্য, কলকাতা কর্পোরেশনের একশদশ-একশআশির কেরাণী তিন চারজন বন্ধু জোগাড় করে, বৌদির গয়নাগাটি বিক্রি করে সস্তায় একখন্ড জমি কিনে একটা নাট্যমঞ্চও বানিয়ে ফেললেন । নাম দিলেন অর্ধেন্দু শেখর মঞ্চধরণীদা বলতেন দেখ, রবীন্দ্র অহিন্দ্র- শিশির- গিরিশ সকলের নামে থিয়েটার হয়েছে, আর যে মানুষটা থিয়েটারকে জমিদারবাবুদের বৈঠকখানা থেকে আমাদের সকলের কাছে নিয়ে এলো তার নামে কোন মঞ্চ হল নাথিয়েটার করার জন্য অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফিরা তখনকার ইংরাজ সরকারের কত লাঞ্ছনা ভোগ করেছিলেন সেইসব গল্প, ‘নীলদর্পণএর গল্প ধরণীদর কাছ থেকেই শুনেছিলাম । আর ধরণীদাও তো থিয়েটার না করতে পারার যন্ত্রণা নিয়েই চলে গেলেন ! এখন যারা ধরণীদার দেহটাকে নিয়ে কামড়া-কামড়ি করবে তাদের কাছে থিয়েটার মানে নাচন-কোদন ছাড়া আর কি ?

          এইসব ছবি দেখতে দেখতে কখন সেই বাড়িটার সামনে চলে এসেছিলাম খেয়াল ছিল না । ততক্ষণে ধরণীদার দেহটার দখল নিয়ে নিয়েছে পাড়ার কেষ্ট-বিষ্টুরা । আর আমি কাল সন্ধ্যাতেও ঐ বাড়িটায় এসেছিলাম, এখন একা, ভীষণ একা । একসময় নাটক করতেন, ধরণীদার হাতে গড়া অনেকেই এলেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে মৃদু কথা-বার্তা চালাচ্ছিলেন । আমি নিশ্চিত তাঁরা এখনও সেই কবে ঘী খাওয়া আঙুলের ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন । আহা, যদি আমার কাছে একটা আয়না থাকতো ! নুটু মিত্তিরও চলে এসেছিলো এবং যথারীতি কানে মোবাইল গুঁজে চেলা-চামুন্ডা পরিবৃত হয়ে নিজেকে জানান দিচ্ছিলো । দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমি মুখে আসা একদলা থুতু ফেলে দাড়িয়েই থাকলাম ।

          বছর দুয়েক আগে ধরণীদা একবার শেষ চেষ্টা করেছিলেন এই নুটু মিত্তির কে ধরে যদি কিছু সরকারী সাহায্য পাওয়া যায়, মঞ্চটা বাঁচে । বলেছিলেন, ‘নুটু তোমার তো সরকারী মহলে অনেক জানাশোনা । পাড়ার ফুটবল ক্লাবের জন্য অনুদান আদায় করে দিলে আর চল্লিশ বছরের মঞ্চটাকে বাঁচানোর জন্য কিছু করবে না ?

          সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নুটু বলেছিল না না ধরণীদা , শুধু নাচন-কোদনের জন্য সরকারী অনুদান পাওয়া যাবে না । আপনাকে তো বলেছিলাম , ওটা দিয়ে দিন , কমিউনিটি হল বানানোর ব্যবস্থা করবো, সভা, সেমিনারও হবে আপনারা নাটক-ফাটকও করবেন । কেন মড়া আগলে বসে আছেন ধরণীদাআর একমুহুর্ত না থেকে ধরণীদা আমাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন । সেই নুটু মিত্তির এখন ধরণীদার দেহ আগলে শেষযাত্রার তদারকি করছে । মনে মনে বলেছিলাম নেই তাই খাচ্ছো, থাকলে কোথায় পেতে’ ?

          নুটু মিত্তিররা বোধয় কার দিন শেষ হয়ে আসছে তার একটা আগাম গন্ধ পায় । ধরণীদা মারা যাবার আগের দিন অসুস্থ মানুষটাকে দেখতে ধরণীদার বাড়ি এসেছিল । বলেছিল এবার আপনার অর্ধেব্দু শেখর নঞ্চের একটা হিল্লে হবে ধরণীদা, আপনি শুধু একটা সম্মতি দিন , কাগজপত্র সব রেডি করে রেখেছি 

          এই ছবিটাও সরে গেল নুটু মিত্তিরের গলার শব্দে। কাকে যেন বললো শোন, গাড়ি বলে দিয়েছি, এখনই চলে আসবে, বডি নিয়ে সোজা নীলরতনে চলে যাবেকে একজন বলল, ‘ অর্ধেন্দু মঞ্চের সামনে একটু দাঁড়াবে না নুটুদা’ ? নিজের হাতে গড়া মঞ্চে যেতেও ধরণীদাকে নুটু মিত্তিরের অনুমতি নিতে হচ্ছে । বললো, ‘আবার ওখানে বডি বানাবি ? ঠিক আছে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিবি না কিন্তু , আর শোন আমি চললাম, আমার আবার থানায় একটা মিটিং আছে

          চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল ময়লা হাতে লোকটা তোমার পবিত্র দেহ ছুতে চাইছে ধরণীদা, ওকে ছুঁতে দিও না । কিন্তু  বলতে পারলামনা , বলার সাহস পেলাম না ।

          এবং কি আশ্চর্য, সেদিন ধরণীদার শোক সভায় সেই সাহসটা পেয়ে গেলাম । বোধয় আমার ওপর ধরণীদা ভর করেছিল সেদিন । 

          শোকসভা শুরু হয়েছে শোক প্রস্তাব পড়া হয়েছে , আমি কিছুই শুনিনি । সকলের শেষে একটা কোণে দাড়িয়েছিলাম ধরণীদার ছবিটার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে । সঞ্চালকের কাঁপা কন্ঠ বললো এবার স্মৃতিচারণ করবেন এলাকার সুপরিচিত সমাজকর্মী ও শিল্প-সংস্কৃতির বিদগ্ধ পৃষ্ঠপোষক মাননীয় নটবর মিত্র মহাশয়

          ধরণীদার ছবিতে একটা মালা লটকে দিয়ে নুটু মিত্তির বলতে শুরু করলো । জানালো আজকের এই শোকসভাতে আমি একটা আনন্দ সংবাদ দিতে চাই । আমি ভাগ্যবান, কারণ আমার সঙ্গেই ধরণীদা শেষ কথা বলেছেন নাটক আর মঞ্চ নিয়ে । গতকালই উনি সম্মত হয়েছেন । এই অর্ধেন্দু মঞ্চের জমিতে তৈরী হবে একটা কমিউনিটি হল । ধরণীদার স্বপ্ন সার্থক হবেআর এই সময়েই আমি প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম মিথ্যে কথা । এই লোকটাই ধরণীদাকে আরো কিছুদিন বাঁচতে দিল না , ধরণীদা গো , কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল এই ফেরেববাজ দের মুলুকে এসে থিয়েটার করতে ?’ কে একজন এসে আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বললো কাকে কি বলছিস খেয়াল আছে ? 

          খেয়াল ছিল বৈকি ! কাল রাতে নুটু মিত্তির যখন অর্ধেন্দু মঞ্চের জমিতে কমিউনিটি হল বানানোর সম্মতি চাইছিল তখন ধরণীদা বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ আমার নিশ্বাস পড়বে ততক্ষণ তো পারবে না নুটু । নিশ্বাস বন্ধ হলে দেহটাকে নীলরতনে পুরে দিয়ে মঞ্চটাকে খাবলে খুবলে খেয়ো, তার আগে নয়আমি তখন পাশের ঘরে, রাতের আয়া মেয়েটার আসার অপেক্ষায় । চলে আসার আগে ধরণীদা শেষ কথা বলেছিলেন তোরাও আর মঞ্চটাকে বাঁচাতে পারবি না রে, শকুনের দল বড় মরিয়া হয়ে উঠেছে

 

বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ১৬

  অন্য ধারার গান : গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী     গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীতধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কা...