বাংলা গানের সেকাল একাল – পর্ব ১৩

 আধুনিক মীরাবাঈ  যূথিকা রায় : তাঁর গান ও সেই সময়


   
১৯৫০/৫২এ আট কি দশ বছর বয়সে তখনও গান শোনার কান তৈরী হয়নি । একটা চারচৌকো কাঠের বাক্স যাকে রেডিও বলা হ, তাতে যখন মীরার ভজন ভেসে আসতো মায়নে চাকর রাখো জীকিংবা মেরে তো গিরিধারি গোপালতখন কে মীরা বাঈ এসব জানার কথা নয় আমার । এবং বলতে লজ্জা নেই এইসব গান যিনি গাইতেন তাঁকেই মীরাবাঈবলে জানতাম । অনেক পরে চিতোর বেড়াতে গিয়ে গাইড যখন একটা ছোট ঘরের ভগ্নাবশেষ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল ঐ ঘরে বসেই নাকি মীরা তাঁর গিরিধারী নাগরের ভজনা করতেন, তখন যূথিকা রায়ের কথা আর তাঁর কন্ঠস্বর সামনে ভেসে আসতো । একেই বোধহয় লিজেন্ডহয়ে যাওয়া বলে ! কিন্তু মীরার ভজন দিয়ে শুরু হয়নি তাঁর সাঙ্গীতিক জীবন, শুরু হয়েছিল আধুনিক বাংলাগান দিয়ে । 

    যূথিকা রায়ের জন্ম ১৯২০র ১৬ই এপ্রিল হাওড়া জেলার আমতায় । ঐ একই বছরে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা গানের দুই প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর মান্না দে । মাত্র সাত বছর বয়সে বাবার হাত ধরে কলকাতায় এসেছিলেন বেতারে গান গাইতে । কলকাতা বেতারের তখন নিতান্ত শৈশব কাল । মাত্র একবছর আগে  বেসরকারী উদ্যোগে কলকাতা রেডিওর পত্তন হয়েছে ১৯২৭এর ১৬ই অগস্ট । তখনও প্রায় কারো ঘরেই রেডিও সেট পৌঁছায়নি । কানে হেডফোন লাগিয়ে বেতারের সম্প্রচারিত কথা শোনা যেতো । কিছু সম্ভ্রান্ত ঘরে রেডিও সেট ঢুকলো আরো কিছুদিন পরে । তখন বিনোদন মূলক বাংলা গান বলতে গ্রামফোন রেকর্ডে লালচাঁদ বড়াল, কৃষ্ণ ভামিনী, ইন্দুবালা, হরিমতী, কমলা ঝরিয়ার প্রেম ও ছলনামূলক ও দেহতত্বের গান, কৃষ্ণ চন্দ্র দের কীর্তনাঙ্গের গান, আর ক্বচ্চিত রবিবাবুর গানলেবেলে দু একটি রবীন্দ্রনাথের লেখা গান । তখনও বাংলা গানের পরিশীলিত গায়ন-রুচি তৈরী হয় নি ।

    মাত্র ১৪ বছর বয়সে যূথিকা রায় প্রথম গ্রামফোন রেকর্ডে গান গাইলেন ১৯৩৪এ কাজী নজরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে । নজরুল তখন কাব্যভুবন থেকে চলে এসে গ্রামোফোন কোম্পানির মাস মাইনের সঙ্গীত পরিচালক, গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গীত বিষয়ক সর্বময় কর্তা । বস্তুত বাংলা গানের স্বর্নযুগের সূচনা হয়েছিল নজরুলের হাতেই । কুকুর-মার্কা এইচ এম ভির লেবেলে যূথিকা দুটি গান রেকর্ড করলেন প্রণব রায়ের কথা ও কমল দাশগুপ্তের সুরে, ‘আমি ভোরের যূথিকাএবং সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে যূথিকার গানদুটি সম্পর্কে হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ড তালিকা-পুস্তিকায় এই শিল্পীর পরিচিতি দিয়ে লেখা হয়েছিল : বিজন বনে কত মুকুল শোভায়-সৌরভে আপনি ফুটে ওঠে, অথচ লোকে তার কথা জানতে পায় না। তেমনি দুটি ফুল এবার আমরা আপনাদের উপহার দিলাম। এই ফুল দুটি কুমারী যূথিকার দুখানি গান। কুমারী যূথিকার গানের সঙ্গে আপনাদের এই প্রথম পরিচয়, কিন্তু মনে হবে যেন ভোরের আধোঘুমে আধোস্বপ্নে এই গান কতদিন মনের দুয়ারে বেজেছে। এমনিই তাঁর কণ্ঠের গান। তাঁর স্বভাব-সুন্দর সুর যেন গিরিনির্ঝরিণীর রূপালী জলধারার মত আপনি উৎসারিত হয়ে ওঠে, দূর-থেকে ভেসে-আসা সানায়ের মতই ঘুমন্ত মনকে জাগিয়ে তোলে। রেকর্ডে গায়িকার গান এই প্রথম। (তথ্যসূত্র – ‘কলকাতার কড়চা’ / আনন্দবাজার ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১৪)

    যূথিকা রায়ের সেই প্রথম রেকর্ডের গান প্রসঙ্গে বাংলা গানের জীবন্ত তথ্যকোষ প্রয়াত বিমান মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ উদ্ধৃত করি, যূথিকা রায়ের নামে বাজারে রেকর্ড বেরুল - আমি ভোরের যূথিকা আর ওই বিখ্যাত সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে - যে গানটাকে এখনকার গবেষক বিশেষজ্ঞরাও অনেকে, আধুনিক বাংলা গান সরণীটির প্রথম মাইলফলক বলে চিহ্নিত করেছেন। কারুর কাছে এটা হয়ত প্রশ্নাতীত নাও হতে পারে, তবু এ গান যে ইতিহাসের উপাদান হয়ে গেছে - তাতে কিন্তু কোনরকম দ্বিমত নেই। সেই বোধহয় রেকর্ডের বাংলা গানে, প্রথম অর্কেস্ট্রা তৈরি হল।... তা, রেকর্ডখানা বাজারে বেরুল। আর মাত্র তিন মাসের মধ্যে যূথিকাদির এই রেকর্ডখানা ষাট হাজার কপি বিক্রী হয়ে গিয়ে বাজারে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিল। রাতারাতি যূথিকাদি হয়ে গেলো আর্টিস্ট, স্টার।’’ (‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে” : শীতাংশুশেখর ঘোষ, পৃ ১৫৪-৫৫ আরো একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলতে হবে, অনেক সঙ্গীত গবেষক বলেন যূথিকার এই গানদুটিই প্রথম আধুনিক বাংলা গানের মান্যতা পাবে।

    তিরিশের দশক বাংলা গানের সুবর্নযুগের সূচনাকাল । ১৯৩২এ শচীন দেববর্মণ প্রথম বেতার ও গ্রামফোনের গানে প্রবেশ করলেন, ১৯৩২এই বাংলা চলচ্চিত্র নির্বাক যুগ পেরিয়ে সবাক হ, ১৯৩৭এ মুক্তিছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ কুমার মল্লিক ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগ ঘটালেন । শচীন দেববর্মণ ও সুরসাগর হিমাংশু দত্তের যুগলবন্দির সুরবৈচিত্রে বাংলা গান যথার্থ অর্থেই আধুনিক হয়ে উঠলোবাংলা গানের কথায় কাব্যের লাবণ্য এল এই সময়ের গানে । এই পর্বেই যূথিকা রায় আধুনিক বাংলা গানের সুবর্ন যুগের নির্মাণে অবিসংবাদী ভূমিকা রেখে গেলেন তাঁর স্বকীয় গায়নশৈলী ও কন্ঠ মাধুর্যের গুনে । ১৪বছর বয়সে প্রথম রেকর্ডের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর গ্রামফোন কোম্পানি একের পর এক কমল দাশগুপ্তর সুরে আধুনিক বাংলা গানের রেকর্ড করাতে লাগলেন । সুরকার কমল দাশগুপ্তর প্রতিষ্ঠার পেছনে যুথিকা রায়েরও অবদান বড় কম ছিলনা । কারণ যুথিকা রায়ের প্রায় সব গানের সুরকার ছিলেন তিনি । যুথিকা রায়ের সংগীতজীবনের প্রায় সবটাই জুড়ে ছিলেন কমল দাশগুপ্ত । নজরুল ইসলাম তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন আর পরবর্তীতে শুধুই কমল দাশগুপ্ত । প্রথম রেকর্ড করেছিলেন নজরুল ইসলামের লেখা ও সুরে কিন্তু যে কোন কারণে সেই রেকর্ড প্রকাশিত হয়নি । হয়তো স্বয়ং নজরুলেরই তা পছন্দ হয়নি । তিনিই তখন কমল দাশগুপ্ত কে সুর করতে বলেন । ১৯৩৯এ নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়লেন । তারপর তো বাক-শক্তিই হারালেন । 

    যূথিকা রায় নজরুলের অনেকগুলি গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন । তাঁর গাওয়া নজরুলের গানের মধ্যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল ওরে নীল যমুনার জলএবং তোমার কালো রূপে যাক না ডুবে সকল কালো মম, হে কৃষ্ণ প্রিয়তমদুটি গানেরই সুর করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত ।

    এই সময় থেকে যূথিকা আধুনিক বাংলা গান থেকে ভক্তিমূলক প্রধানতঃ ভজন গানে চলে এলেন । যূথিকা স্মৃতিচারণ করেছেন এরপর প্রথমে কমল দাশগুপ্ত আমাকে একটা মীরার ভজন শেখালেন, সেই মীরার ভজন যখন দাঁড়িয়ে গেল, পপুলার হলো, ফার্স্ট যখন মীরা কে প্রভু সাঁচী দাসী বানাও’ - এই গানটা বেরিয়ে পপুলার হলো, তখন ওই গ্রামোফোন কোম্পানির থেকে বলা হলো, যতগুলো মীরার ভজন আছে সব যূথিকাকে দিয়ে

গাওয়ানো হবে । 

    চল্লিশের দশক বাংলা গানের ভুবন যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে । হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, বেচু দত্ত প্রমুখ অনেক শিল্পী, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, মোহিনী চৌধুরী, অজয় ভট্টাচার্যর মত গানের কথাকার, দুর্গা সেন, অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষ, সলিল চৌধুরীর মত সুরকার সেই সময়ের ফসল । হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পনেরো বছর বয়সে প্রথম বেতারে গান গাইলেন ১৯৩৫এ, ১৯৩৭ এ তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বেরিয়ে গেল কথা কয়োনাকো, শুধু শোনজানিতে যদিগো তুমিবাংলা গানের ভুবনে অনেক শিল্পীর আবির্ভাব সত্বেও আধুনিক বাংলা গানের বাইরে যে অন্য ধারার গান সেখানে গায়নশৈলীর স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে রইলেন যুথিকা রায় । 

    যূথিকার সঙ্গীত জীবনের প্রথম পর্বের গানগুলিতে রোমান্টিকতার সঙ্গে পাওয়া যায় একটা বিষাদ বিষন্নতার ছবি, আর ভজন গানে তাঁর গায়কীতে বিভোর, তন্ময় আত্মনিবেদন । একের পর এক মীরার ভজন গাইতে গাইতে আধুনিক মীরা বাঈএর পরিচিতি পেয়ে গেলেন যূথিকা রায় । প্রায় তাঁর সমকালেই পন্ডিত ডিভি পালুশকর কিংবা অনেক পরে অনুপ জলোটা এবং আরো অনেক শিল্পী ভারতজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন, কিন্তু মীরার ভজন গানে যূথিকা রায়ের যে শ্রদ্ধার আসন তাকে স্পর্শ করতে পারেননি কেউ । এই আধুনিক মীরাহয়ে ওঠা তাঁকে বিরল সম্মান এনে দিয়েছিল । সেসব কথা যূথিকা নিজেই লিখে গেছেন তার স্মৃতিচারণ মূলক বই আজও মনে পড়েতে এবং নানান সাক্ষাৎকারে । 

    ১৯৪৭এর পনেরোই অগষ্ট । সেদিন রেডিওতে যুথিকার গানের সিটিং ছিল । ঘটনাক্রমে সেদিন লালকেল্লায় স্বাধীন ভারতে প্রথম জাতীয় পতাকা তুলবেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু । যূথিকার পনেরো মিনিটের রেডিও সিটিং শেষ হয়েছে, ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত । তখনই টেলিফোনে সংবাদ এলো, প্রধান মন্ত্রী নেহেরু চাইছেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পুরো সময়টা রেডিওতে যেন যূথিকা রায় গান গাইতে থাকেন । নেহেরু তখন তিনমূর্তি ভবন থেকে লালকেল্লার পথে রওনা দিয়েছেন । যূথিকা আবার বসলেন গান গাইতে । গান্ধীজীর প্রিয় রামধুন ভজন ও দেশভক্তিমূলক সহ সাত/আটটি গান গেয়েছিলেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় । যূথিকার এমনই প্রবল জনপ্রিয়তা ছিল । নেহেরু নিশ্চয়ই জানতেন গান্ধীজী তাঁর দৈনিক প্রার্থনার আগে যূথিকার ভজন শুনতেন । ১৯৪৬এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় গান্ধীজী কলকাতায় এসেছিলেন সত্যাগ্রহে । মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলেন যূথিকাকে, তাঁর ভাষণের আগে গান গেয়েছিলেন যূথিকা রায় । 

    তখন ছায়াছবিতে গান গাওয়া যে কোন শিল্পীর খুব কাঙ্খিত ছিল, শিল্পীর জনপ্রিয়তার একটা মাপকাঠি ছিল ছায়াছবিতে গান করা । কিন্তু ছায়াছবিতে গান করা যূথিকাকে টানেনি একদম । তিনি যে তন্ময়তায় ভজন গাইতেন তেমন পরিবেশ তখনকার সিনেমায় থাকতো না বলেই মনে করতেন যূথিকা । এ ব্যাপারে তাঁর মায়ের রক্ষণশীলতাও তাঁর সিনেমায় গান না করার একটা কারণ ছিল । তবু দুটি ছায়াছবিতে তিনি নেপথ্য সঙ্গীতে ছিলেন । তখনকার প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক দেবকী কুমার বসুর হিন্দি ছবি রত্নদীপছবিতে, মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫১তে এবং পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীতপ্রধান ছবি ঢুলি’, ১৯৫৪ তে । তাঁর দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে আর কোন বাংলা বা হিন্দি ছায়াছবিতে তিনি গান করেননি । 

    বস্তুত পঞ্চাশ দশকের শেষ থেকেই তিনি অনুষ্ঠানে গান করা ছাড়া রেকর্ডের গান করা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন । তাঁর প্রায় সব গানের সুরকার কমল দাশগুপ্তের সৃষ্টিশীলতাও কমে যায় । অসুস্থতার কারণে রেকর্ডে সুর করা বন্ধ করে দিলেন । যূথিকাও গানের নতুন  রেকর্ড করা বন্ধ করে দিলেন । এই সময় শ্যামল গুপ্তর লেখা কয়েকটি গানে নিজে সুরও দিয়েছিলেন যূথিকা । আর অন্যকোন সুরকারের সুরে যূথিকাতো গানই করেনইনি । কমল দাশগুপ্ত রেকর্ডের গানে সুর করা বন্ধ করে দেওয়ার পর গ্রামফোন কোম্পানী তাঁর ইচ্ছামত যে কোন ট্রেনারের সঙ্গে গান করার অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু যূথিকা অন্য কোন ট্রেনারের প্রশিক্ষণে গান করায় সম্মত হননি যদিও তখনও তাঁর কন্ঠে গান ছিল আর তাঁর গানের জনপ্রিয়তা ও চাহিদা ছিল । তখন তিনি রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদের গানে চলে এলেন । এইসময় বাংলা ও হিন্দি ছাড়া উর্দু ও তামিল ভাষাতেও ভক্তিমূলক গান করেছিলেন তিনি । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান করেননি । অবশ্য যুথিকা রায়ের সঙ্গীত জীবনের শীর্ষ সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙ্গালির কাছে এখনকার মত সর্বগ্রাসী ছিলই না বরং বলা ভালো ১৯৬১তে তাঁর শতবার্ষিকীর আগে বাঙ্গালির রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার কানই তৈরী হয়নি । অথচ মজার কথা সাত বছর বয়সে বেতারে যূথিকার প্রথম গানটিই ছিল রবীন্দ্র নাথের আর রেখোনা আঁধারে, আমায় দেখতে দাও 

    জন্ম হাওড়া জেলার আমতা, পরিবারের আদিবাড়ি খুলনা জেলার সেনেটি গ্রাম । শৈশবশিক্ষা, গানকে ভালোবাসার শুরু সেখানেই, তারপর ১৯৩০ থেকে কলকাতায় পাকাপাকি বাস । আর গানেরতো কোন দেশ কাল হয় না । বয়সও হয়না । বিস্ময় লাগে, এই সেদিন, ২০১৩র পূজোর ঠিক আগে, ৯৩বছর বয়সে মুম্বাইতে গানের অনুষ্ঠান করলেন । সেটাই তাঁর শেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান । রেকর্ডে গান করা ছেড়ে দেবার অনেকদিন পরে বিশেষ অনুরোধে একটি সাঁইবাবার ভজন রেকর্ড করেন ১৯৭৬এ এবং এটি তাঁর শেষ রেকর্ডের গান । 

    ২০১৪’র জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কলকাতার মানুষ যখন দক্ষিণ কলকাতার রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল চত্বরে হামলে পড়েছে অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের শারীরিক অবস্থা জানার জন্য, তখনই ঐ হাসপাতালের কোন একটি ওয়ার্ডে সুচিত্রা সেন অভিনীত ঢুলিছায়াছবির এক নেপথ্য সঙ্গীত শিল্পী, ৯৩ বছরের এক বৃদ্ধা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে শায়িত ছিলেন সকলের আগ্রহের অন্তরালে । সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পরে ৬ই ফেব্রুয়ারি রাত্রি এগারোটায় চলে গেলেন আধুনিক মীরা বাঈযূথিকা রায় । সময়ের স্রোত হয়তো আমাদের অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়, তার মধ্যে অস্বাভাবিকতাও নেই কিছুমাত্র, তবু শিল্পীর সৃষ্টি বেঁচে থাকে । যতদিন গানশোনা মানুষ মীরার ভজনশুনতে চাইবেন, তাঁকে বোধকরি আধুনিক মীরাযুথিকা রায়ের গানের কাছেই যেতে হবে ।

    গত শতকের চল্লিশের দশক এলো বাংলাগানের স্বর্ণসময় নিয়ে । কৃষ্ণচন্দ্র দে, ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়া, পঙ্কজ মল্লিকদের পরের প্রজন্ম উঠে এলেন – শচীন দেব বর্মন, সুধীরলাল চক্রবর্তী, জগন্ময় মিত্র, যূথিকা রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্যচৌধুরী, বেচু দত্ত, সুপ্রভা সরকার, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য, রবীন মজুমদার প্রমুখ পঞ্চাশের দশকে এলেন আরো এক ঝাক শিল্পী – সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অখিলবন্ধু ঘোষ প্রমুখ । মুলত এঁরাই শাসন করলেন বাংলাগানের জগৎ সত্তরের দশক পর্যন্ত । সে ছিল বাংলা গানের স্বর্ণ-সময়, সোনার দিন, শোনার দিনও । সেকথা পরের পর্বে ।

(আগামী পর্বে বাংলা গানের সোনার দিন, শোনার দিন । )

 

 

 

 

 

বাংলা গানের সেকাল একাল – পর্ব ১২

 ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’

    গত শতকের তিরিশের দশকে বাংলা গানের তিন কিংবদন্তী শিল্পী হলেন ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা ও কমলা ঝরিয়া । এঁরা যখন গ্রামফোনের গানের জগতে এলেন তখন বাংলা গানের জগতে কাজী নজরুল ইসলামের অবিসংবাদী দীর্ঘ ছায়া । গ্রামফোন কোম্পানীতে সঙ্গীত বিষয়ের সর্বময় কর্তা,কথা ও সুরের জাদুতে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন,আর তাঁর সংস্পর্শে ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা,কে মল্লিক,কমলা ঝরিয়া,ধীরেন দাস,মৃণালকান্তি ঘোষ, জ্ঞাণেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, কানন দেবী, সুপ্রভা সরকার, গিরীন চক্রবর্তীদের কন্ঠে বাংলা গানের ঐশ্বর্যের নির্মাণ হয়ে চলেছে । নজরুলের কন্ঠ স্তব্ধ হওয়ার পর ফিরোজা বেগম, যুথীকা রায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মত অনেক শিল্পী নজরুলের গানে দীক্ষিত হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন অনেকেই ।

আঙুরবালা

    শৈশবে দেখেছি গ্রামফোন রেকর্ডের খামে কৃষ্ণচন্দ্র দে, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, হরিমতি,কমলা ঝরিয়াদের ছবি ছাপা থাকতো । এঁরা তখন বাংলা গানের মহা তারকা । মহা তারকার চেয়েও বড় কোন বিশেষণ থাকলে সেটাও প্রাপ্য আঙ্গুরবালার । ১৬ বছর বয়সে তাঁর প্রথম গান প্রকাশিত হয় । তিরিশ ও চল্লিশ দশকে সবচেয়ে বেশি রেকর্ড বিক্রি হত তাঁর গানের রেকর্ড । প্রতি মাসে চারটি করে গান প্রকাশিত হত তাঁর সে যুগে একজন শিল্পীর একই মাসে এতগুলি গানের প্রকাশ বিস্ময়কর । এমনই ছিল তাঁর গানের চাহিদা । তাঁর গানের রেকর্ডের সংখ্যা প্রায় পাঁচশো । খুব মধুর কন্ঠস্বরের জন্য তাঁকে বলা হত বাংলার বুলবুল

    আঙুরের জন্ম কলকাতা সন্নিহিত কাশীপুরে ১৮৯৬ সালের জুলাই মাসে বাংলা ৭ই শ্রাবণ ১৩১৩ পিতার সুধীর কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতার নাম হরিমতী । পিতৃদত্ত নাম প্রভাবতী, বালিকা বয়সে গান রেকর্ড করার পর কন্ঠের মিষ্টতার জন্য কেউ নাম দিলেন আঙুরবালা ।

    বাংলা রেকর্ডের গানে আসার অনেক আগেই তিনি এসেছিলেন থিয়েটারে গায়িকা হিসাবে ১৯১২তে বালিকা বয়সে মুক্তার মুক্তিনামে নাটকে । তারপর ১৯২২ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত অনেকগুলি নাটকে অভিনয় ও গান করেছেন । আর এই থিয়েটারের সূত্রেই তাঁর পিতৃদত্ত নাম প্রভাবতী হয়ে গিয়েছিল আঙুরবালা । ১৯১২তে গিরিশচন্দ্রর মৃত্যুর পরে বাংলা নাট্যমঞ্চে কিছুটা শূন্যতা আসে । থিয়েটারে তেমন ভিড় হচ্ছিল না । সেকালে ভালো গান থিয়েটারে দর্শক টেনে আনত । ইতিমধ্যে গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে আঙুরের । স্টার থিয়েটারের নৃত্যশিক্ষক ললিতমোহন গোস্বামী তাঁর পারিবারিক সম্মতি নিয়ে আঙুরকে থিয়েটারে নিয়ে আসেন । ললিতমোহনই প্রভাবতীর থিয়েটারের নাম দিয়েছিলেন আঙুরবালা । আঙুরবালা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন সেদিন সেই মুহুর্তে স্টার থিয়েটারের লবিতে দাঁড়িয়ে যে নামকরণ করেছিলেন ললিত কাকা, সেই নামের গ্ল্যামার আর মোহ আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে । ওই নামের চটকের আড়ালে কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আমার মায়ের শখ করে দেওয়া নাম প্রভাবতী । এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ললিত কাকার দেওয়া আঙুরবালা নামের সব গৌরব আর যন্ত্রণা” (তথ্যসূত্র রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী’/ অমিত মৈত্র)

    সেই সময় ভারতের সঙ্গীত জগতে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। দেশের বিভিন্ন রাজা মহারাজার দরবারে মেহফিলে গান শুনিয়ে তিনি দেশ জোড়া খ্যাতি ও সম্মান লাভ করেছিলেন । তার মধ্যে মহীশূর রাজ দরবারে এবং হায়দরাবাদের নিজামের দরবারে তাঁর মেহফিলের কথা ইতিহাস হয়ে আছে । এক সময় তাঁর মুজরোর দক্ষিণা ছিল তিরিশ হাজার টাকা। এক সময় অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু গান ছাড়েননি । পরিণত বয়সেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন।

    ১৯২৮ সালে নজরুলের কথায় সুরে ও পরিচালনায় তিনি প্রথম দুটী গান রেকর্ড করেন, গানদুটি ছিল ভুলি কেমনে আজও যে মনেএবং এত জল ও কাজলচোখে পাষাণী আনলে বলো কেরেকর্ড করেছিলেন  তারপর আঙুরবালা হয়ে উঠেছিলেন নজরুলের গানের এক অপ্রতিদ্বন্ধী শিল্পী । নজরুনের কন্টো স্তব্ধ হওয়ার পর আঙুরবালাই  নজরুলগীতির অথরিটির মান্যতা পেয়েছিলেন । রেকর্ড কোম্পানী এইচএমভি তাকে নজরুল সঙ্গীতের প্রশিক্ষক নিযুক্ত করেছিল । পঞ্চাশের দশকে তার প্রশক্ষণে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মত অনেক শিল্পী নজরুলসঙ্গীতে দীক্ষিত হয়েছিলেন ।

    অনেক সম্মাননা পেছেন আঙুরবালা,কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট । ১৯৭৬ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি আঙ্গুরবালাকে গোল্ডেন ডিস্ক দিয়ে সম্মানীত করেছিল। এ ছাড়াও তিনি পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার। ১৯৭২এ তিনকন্যানামে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল যেখানে অন্য দুই প্রবাদপ্রতীম শিল্পী ইন্দুবালা ও কমলা ঝরিয়ার সঙ্গে তাঁর জীবনকথাও উঠে এসেছিল ।

    ৭ই জানুয়ারি ১৯৮৪তে চিরতরে থেমে যায় বাংলার বুলবুলের কন্ঠস্বর, চিরবিদায় নেন বাংলা গানের কিংবদন্তী আঙুরবালা । প্রায় একশো বছর আগে, ১৯২৭এ ‘নর্তকী’ নাটকে একটি গান গেয়েছিলেন আঙুরবালা । অতুলপ্রসাদের ‘আমার জীবন নদীর ওপারে, এসে দাঁড়ায়ও দাঁড়ায়ও বধু হে” এর চল্লিশ বছর পরে ছুটি ছায়াছবিতে প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে গানটির রি-মেক শুনে আচ্ছন্ন হয়ে যাইআঙুরবালা্রা এভাবেই বেঁচে থাকেন ।

কমলা ঝরিয়া

    শৈশবে একটা আগমনি গান শুনেছিলাম আনন্দে মাতে গিরি রাজপুরীঐ গানটাই য়ামার শৈশবমনে জানান দিত পূজো আসছে, পূজোর গন্ধ ছিল সেই গানে । রেকর্ডের লেবেলে শিল্পীর নাম লেখা ছিল কমলা ঝরিয়া । ব্যস এইটুকুই । তারপর একটু বড় হতে বাবার কাছে বসে কলেরগান শুনতে শুনতে, গ্রামফোন রেকর্ড আর রেকর্ডের গানের তালিকা ঘাঁটতে ঘাঁটতে বাংলা গানের যুগ-নির্মাতা কৃষ্ণচন্দ্র দে, ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়াদের চিনতে শুরু করেছিলাম । কীর্তন, রাগপ্রধান, প্রণয়সঙ্গীত, ঠুংরি, আগমনি, ঝুমুর কত গান যে শুনেছিলাম, সেইসব স্মৃতি মনে পড়ে আজ, স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছন্ন হই জীবনের শেষ প্রান্তে পৌছে ।

    কমলার বংশগত পদবী ছিল সিংহ, পরিচিতি পেলেন কমলা ঝরিয়া । সাবেক বিহারের (এখন ঝাড়খন্ড) ধানবাদ জেলার রুক্ষ মাটির কয়লা খনি অঞ্চল ঝরিয়া ইয় জন্ম কমলার । কমলার পারিবারিক পরিচয় বিশেষ কিছু জানা যায় না সেই নিষিদ্ধ সময়ে গান গাওয়া মেয়েদের সম্মানজন পারিবারিক পরিচয় থাকতো না, আমরা জানি । ঝরিয়ার রাজা ছিলেন সঙ্গীত-অনুরাগী । সুখ্যাত গায়ক ক।মল্লিক তখন ঝরিয়ার রাজদরবারের সভাগায়ক ছিলেন । গানের প্রতি কমলার উৎসাহ দেখে রাজা বালিকা কমলাকে কে মল্লিকের কাছে গান শেখার সুযোগ করে দেন । ঝরিয়ার রাজদরবারে কমলার প্রতিভা বিকশিত হয় । কে মল্লিক কমলাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বেতার ও গ্রামফোন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন, কমলার সঙ্গীতজীবনের মোড় ঘুরে যায় । ১৯৩০এর সেপ্টেম্বরে প্রণব রায়ের কথা ও তুলসী লাহিড়ীর সুরে এইচএমভি রেকর্ডে দুটি গান করেন ‘প্রিয় যেন প্রেম ভুলো না’ এবং ‘নিঠুর নয়ন বাণ কেন হানো’ কমলার প্রথম গানদুটি সঙ্গীত রসিক মহলে সাড়া জাগায় তাঁর কন্ঠস্বর ও গায়কীর জন্য । তখন রেকর্ডের গানে কে মল্লিক, ইন্দুবালা, আঙুরবালার তুমুল জনপ্রিয়তা । ক্রমে কমলাও তাঁদের সঙ্গে একই পংক্তিতে যায়গা করে নিলেন ।

    নজরুলের কথা ও সুরে কমলার কন্ঠে একটি গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘আমায় নহেগো – ভালোবাসো, ভালোবাসো মোর গান, বনের পাখীরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান’ নজরুলের গানের এই কথা হয়তো অনেক শিল্পীর জীবনেই সত্য হয়ে ওঠে, কমলার জীবনেও তাঁর এই গানের কথা সত্য হয়ে উঠেছিল । ২০শে ডিসেম্বর ১৯৭০তে তার মৃত্যুর পর একমাত্র মেগাফোন কোম্পানির কর্তৃপক্ষ বিন্ন সেই সময়ের কোন শিল্পী বা প্রতিষ্ঠান প্রয়াত শিল্পীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে আসেননি (সূত্র- দেশ পত্রিকা ৫ জানুয়ারি ১৯৮০/ আবুল আহসান চৌধুরীর ‘কমলা ঝরিয়া ; স্মৃতি বিস্মৃতির আলোছায়ায়’ নিবন্ধে উদ্ধৃত)

    কমলার সঙ্গীতজীবনে দুজন মানুষের ঋণ সর্বাধিক । তাঁরা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও তুলসীদাস লাহিড়ী । নজরুলের সান্নিধ্য ও শিক্ষা কমলাকে সমৃদ্ধ করেছে তাতে সংশয় নেই । আব্বাসুদ্দিন আহমেদ, আঙুরবালা প্রমুখ নানা সময়ে তাঁদের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন । ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত কমলা নজরুল ইয়াওলামের কথা ও সুরে অনেক গান গেয়েছেন এবং সেই সময়ের সার্থক নজরুল-সঙ্গীত শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছিলেন । তারপর কমলার জীবনে আসেন নাট্যকার-গীতিকার-সুরকার তুলসী লাহিড়ী । এরপর কমলা বেশি গান করেছেন তুলসী লাহিড়ীর কথা-সুর ও প্রশিক্ষণে ।

    কমলার সঙ্গে তুলসী লাহিড়ীর সম্পর্ক গভীর হয়েছিল, তাঁর কলকাতায় আসার পর থেকেই । কমলার শিল্পী ও ব্যক্তিজীবনেও এই গুণী মানুষটি ছায়ার মতো ছিলেন। কমলারও তাঁর প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও নির্ভরতা। দুজনের এই সম্পর্ক তুলসী লাহিড়ীর মৃত্যুকাল ১৯৫৯ পর্যন্ত বজায় ছিল । ১৯৫৯এর ২২শে জুন কমলা ঝরিয়ার রাসবিহারী এভিনিউএর বাড়িতেই তুলসী লাহিড়ীর মৃত্যু হয় । তুলসী লাহিড়ীর মৃত্যুর পর কমলা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, গানের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন । গানের কোন রেকর্ড করেননি এরপর । মৃত্যুর বছর তিনেক আগে গ্রামফোন কোম্পানির তাকে গোল্ডেন ডিস্ক প্রদান সম্মাননা অনুষ্ঠানে তার শেষ উপস্থিতি

    কমলার গানের রেকর্ডের সংখ্যা চারশোরও বেশিএবং নানা ভাষায় তিনি গান করেছেন । বাংলা ছাড়া হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবী। মারাঠি ভাষাতেও তিনি গান রেকর্ড করেছেন । এবং নজরুলের গান ছাড়া নানা ধারার গান, পদাবলী কীর্তন, আগমনি, রামপ্রসাদী, ভজন বাংলা ঠুংরি, দেহতত্বের গান, গজল, কাওয়ালি, বাউল, রাগাশ্রিত বাংলা গান ভাটিয়ালি কি না গেয়েছেন কমলা, সবেতেই ছিল তাঁর অনায়াস দক্ষতা । ঝুমুর গানও গেয়েছেন কমলা প্রখ্যাত ঝুমুরশিল্পী সিন্ধুবালা দেবী জানিয়েছেন যে তিনি কমলার সঙ্গে ঝুমুর গান গেয়েছেন পুরুলিয়ার কাশীপর রাজবাড়িতে । গ্রামফোন রেকর্ডে অবশ্য কমলার কোন ঝুমুর গান ধরা নেই ।

    ১৯৭৫এ নজরুলগানের তিন কন্যা ইন্দুবালা, আঙুরবালা ও কমলা ঝরিয়াকে নিয়ে বাইশ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব শ্যামল ঘোষ, ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’ নামে । তথ্যচিত্রটির উদবোধনী-প্রদর্শণী তে উপশ্তহিত ছিলেন সত্যজিৎ রায় তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবার জন্য । উপস্থিত ছিলেন ঋত্বিক ঘটকও ইন্দুবালা, আঙুরবালা এসেছিলেন কিন্তু কমলা আসতে পারেননি । তথ্যচিত্রটি বিস্মৃতির ধূসর জগতে চলে যাওয়া বাংলা গানের তিন কিংবদন্তীকে নতুনকরে আলোয় নিয়ে এসেছিল ।

    এইচএমভি-র পক্ষ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৭৬ কলকাতার রবীন্দ্রসদনে আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কানন দেবী, পঙ্কজকুমার মল্লিক, যুথিকা রায় ও কমলা ঝরিয়াকে গোল্ডেন ডিস্কদিয়ে সম্মাননা জানানো হয়েছিলঅনুষ্ঠানের স্মারকপত্রে কমলা ঝরিয়া সম্পর্কে লেখা ছোটো এক পরিচিতি দেওয়া হয়েছিল । সেটি উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করি : সংগীতের আসর থেকে অবসর নিয়েও তিনি নির্লিপ্ত নিষ্কামভাবে সংসারের বেদির ওপর জীবনের শেষ নৈবেদ্য অর্পণ করেছেন, আর আমাদের দান করেছেন সংগীতের এক সম্পন্ন বর্ণোজ্জ্বল উত্তরাধিকার। বাঙালির গানে শ্রীমতী কমলা ঝরিয়া একটি প্রদীপ্ত যুগের দেবদেউলের প্রোজ্জ্বল হোমশিখা” (তথ্যঋণ : কমলা ঝরিয়া : স্মৃতি বিস্মৃতির আলোছায়ায় / আবুল আহসান চৌধুরী)

নজরুলের গানের পাখি ফিরোজা বেগম

    কোন কোন শিল্পী তাঁর নানান সৃষ্টির মধ্যে যে বিশিষ্টতা অর্জন করেন সেই বিশিষ্টতার মধ্যেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকেন মৃত্যুর পরেও বহুকাল । ফিরোজা বেগম ছিলেন তেমনই এক শিল্পী যাকে শুধু একজন সংগীত শিল্পী বলে চিহ্নিত করলে সবটুকু বলা হয় না । নজরুল-গানের শিল্পী হিসাবে নিজেকে কিংবদন্তীর  উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ফিরোজা । সেই কবে, ১৯৪২এ ফিরোজা তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন, বারো বছর বয়সে প্রথম কলকাতায় রেডিওতে গান গাইলেন । ফিরোজার গান গাওয়ার পাঠ শুরু অবশ্য তার আগে থেকেই । ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম ফিরোজার, ২৮শে জুলাই ১৯৩০ এবং কি আশ্চর্য স্বামী কমল দাশগুপ্তর জন্মতারিখটাও ছিল তাঁর জন্মের ১৮বছর আগের এক ২৮শে জুলাই । পিতা মোহম্মদ ইসমাইল ছিলেন নামী আইনজীবি । মাতা বেগম কাওকাবুন্নেশা ছিলেন সংগীতানুরাগী । ছয় বছর বয়স থেকেই ফিরোজার গান গাওয়ার শুরু । কিন্তু তাঁর ফিরোজা বেগমহয়ে ওঠা মোটেই কুসুম বিছানো পথ ছিল না ।

 

    অনেকেই নজরুলের প্রচুর গান গেয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন । সেইসব শিল্পীর কোন একটি বা দুটি গান গায়নগুনে অন্যতর মর্যাদা পেয়ে যায় । সুপ্রভা সরকার গীত কাবেরী নদীজলে কে গো’, জ্ঞাণেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামীর শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রর শাওন আসিল ফিরেকিংবা শচীনদেব বর্মণ গীত কুহু কুহু কোয়েলিয়াএমনই গান, যেগুলি অন্য অনেক শিল্পী গাইলেও মনে থাকে তাঁদেরই গায়নশৈলী । একই কথা বলতে হবে ফিরোজা বেগমের গান সম্পর্কে । ১৯৬০সালে পূজায়, গ্রামফোন রেকর্ডে গাওয়া দুটি গান দূর দ্বীপ বাসিনীএবং মোমের পুতুল মমির দেশেফিরোজাকে প্রবল জনপ্রিয় করে তোলে । এই গান অনেকেই হয়তো গেয়েছেন, কিন্তু সংশয় নেই যে গানদুটির জন্য ফিরোজা বেগমের কথাই মনে এসে যায় । তেমনই নূরজাহান’,  চাঁদ সুলতানা’, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’, ‘আমি চিরতরে দূরে সরে যাব’, ‘ওরে নীল যমুনার জলচিলএমনই বরষা ছিল সে দিন’, ‘মুশাফির মোছরে আখী জলএমন বহু কালজয়ী নজরুল গানে তাঁর কন্ঠের ইন্দ্রজাল অক্ষয় হয়ে আছে ।

    ৯ বছর বয়সে ফিরোজা কলকাতায় আসেন । কলকাতায় কোন এক গানের আসরে নজরুল ইসলাম তাঁর গান শুনে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন । নজরুল তখনও সুস্থ ও পূর্ণ দীপ্তিতে এবং গ্রামফোন কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক । এই সময়েই ফিরোজা গ্রামফোন কোম্পানীতে অডিশন দেন । নজরুল ইসলামের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছিলেন এই সময়ে । তারপর ১২ বছর বয়সে ফিরোজার প্রথম গ্রামফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪২এ চিত্ত রায়ের সুরে । গানটির কথা মরুর বুকে জীবনধারা কে বহালঐ বছরই কমল দাশগুপ্তর তত্বাবধানে দুটি উর্দু গান রেকর্ড করেছিলেন ।

    ফিরোজা তাঁর কৈশোরে নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন । কিন্তু বাংলা সংগীত ভুবনে তাঁর সূচনা পর্বের সময় নজরুল নজরুল নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন । গ্রামফোন কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক তখন নজরুল স্নেহধন্য কমল দাশগুপ্ত । ১৯৪০এর দশক থেকে ষাটের দশকটা ছিল বাংলাগানের স্বর্ণ যুগ । আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে তখন শচীন দেববর্মণ, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যুথিকা রায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত, সুপ্রভা সরকার, তালাত মাহমুদের মত গায়ক, হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষের মত সুরকার সে এক বিস্ময়কর শিল্পী সমাবেশ । ফিরোজা যুক্ত হলেন এই শিল্পী সমাবেশে । মনে রাখা দরকার যে, তখন সমভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে মেয়ের পক্ষে রেকর্ডে গান করা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না ।

    নজরুল ইসলাম নীরব হয়ে গেলেন, কিন্তু বাংলা গানের ভান্ডারে রেখে গিয়েছিলেন কয়েক হাজার গান । ফিরোজা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি অন্য কোন গান নয়, শুধু নজরুলের গানই গাইবেন । তাঁর নজরুল গীতির কিংবদন্তী শিল্পী হয়ে ওঠায় শংসয়াতীত অবদান ছিল কমল দাসগুপ্তর । কমল দাশগুপ্ত নিজে নজরুলের বহু গানে সুর দিয়েছিলেন । গ্রামফোন কোম্পানির সঙ্গীত প্রশিক্ষক থাকা কালীন তিনি একের পর এক নরুলের গান গাইয়ে ছিলেন ফিরোজাকে দিয়ে । নজরুল-গানের মাধুর্যের প্রতি ফিরোজার যে টান তার নির্মাণ করে দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্তই । পাকা জহুরীর মত তিনি চিনেছিলেন ফিরোজা কে । যে ভাবে কমল দাশগুপ্ত ফিরোজার অগ্রজা-প্রতীম যুথিকা রায়কে মীরার ভজনের অনন্য শিল্পী করে তুলেছিলেন ।    নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯সালে। এরপর থেকে আর ফিরোজাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । নজরুল সঙ্গীতের নানা রসধারায় সিক্ত হয়ে ফিরোজা বেগম গেয়েছেন, রেকর্ড করেছেন এবং শ্রোতাদের বিমোহিত করেছেন সুরের ইন্দ্রজালে। ফিরোজার কন্ঠ মাধুর্যে যেন নজরুল জীবন্ত হয়ে উঠতেন তাঁর গানে । ফিরোজা বেগম নজরুলের সব ধরনের গান গেয়েছেন। গজল, কীর্তন, ইসলামী গান, দাদরা-নানা ঢঙের সঙ্গীতরসে সিক্ত সঙ্গীতের মালা গেঁথে গেলেন তিনি সেই কৈশোর থেকে আমৃত্যু ।

    ফিরোজা ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ এই ১৩বছর কলকাতায় ছিলেন । এই সময়েই ফিরোজার প্রতিষ্ঠা । এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন দীর্ঘ সময় চিত্ত রায় ও কমল দাশগুপ্তের কাছে গান শিখেছি। কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকে অনেক ধরনের গান শিখেছি। সেই সময় আমরা সবাই এক পরিবারের মতো ছিলাম। একসঙ্গে গান-বাজনা এবং নিয়মিত গানের চর্চা করতাম। প্রায়ই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যেও গান করেছি। পরিবারের কাছ থেকে গান-বাজনা করার জন্য বেশ উৎসাহ পেতাম। তাই হয়তো গান-বাজনা করতে আমার কোনো বাধা ছিল নাতাঁর সংগীত প্রশিক্ষক, বয়সে তাঁর চেয় ১৮বছরের বড় কমল দাশগুপ্তর সঙ্গেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন ফিরোজা কলকাতায় ১৯৫৫তে ।

    ফিরোজার পরিবার, আত্মীয়-পরিজন ও কাছের মানুষেরা ওদের অসম বিবাহ মেনে নেয় নি । ফলে বিবাহপরবর্তী দাম্পত্যজীবন অনেক দুঃখময় থেকেছে । কলকাতায় কমল দাশগুপ্তর কোন বাড়ী ছিলনা । সেই সময়, নানান বিপর্যয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা মোটেই ছিল না । হাতে তেমন কাজও ছিল না । একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে গিয়ে আর্থিক বিপর্যয় ঘটে যায় । তার মধ্যেই ফিরোজা স্বামীর সঙ্গে নজরুলের গান ও স্বরলিপি সংরক্ষণে নিরলস কাজ করে গেছেন । নির্বাক অসুস্থ নজরুলকে গান শোনাতেন । নজরুলসংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে গিয়েছেন । ফিরোজা-কমলদাশগুপ্তর অসম বিবাহ কলকাতাও খুব আদরের সঙ্গে মেনে নিয়েছিল এমন নয় । বিস্ময়কর মনে হবে যে, কলকাতায় থাকাকালীন অজস্র নজরুলগীতি রেকর্ডে গেয়েছিলেন ফিরোজা, কিন্তু কলকাতার একটিও গানের জলসায় গান গাইবার জন্য তাঁর উপস্থিতি দেখা যায় নি । অথচ বাংলা গানের সেই স্বর্ণ যুগে কলকাতায় গানের জলসা লেগেই থাকতো । ১৯৭২এর ২৭শে অক্টবর কলকাতার রবীন্দ্র সদনে প্রথম একক সংগীতানুষ্ঠান করেন ফিরোজা । তখন তিনি ঢাকায় চলে গিয়েছেন সপরিবারে ।

    ১৯৬৭তে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য সপরিবারে ঢাকায় চলে গেলেন ফিরোজা । ওখানে তখন আয়ুব খানের সামরিক শাসন । শোনা যায় ফিরোজাদের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঢাকা ছাড়ার ফতোয়া জারি হয়েছিল । সেই সময় তাঁর পরিবার ও অনেক মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কোন সমঝোতা করেননি ফিরোজা । তাই সেই আয়ুব খান সরকার যখন ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রের উদবোধনে প্রথম গানটি গাইবার জন্য ফিরোজা বেগমকে আমন্ত্রণ করেন, ফিরোজা শর্ত দিয়েছিলেন তিনি উর্দু নয় - বাংলা গান গাইতে দিতে হবে । নজরুলের ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি, আমার দেশের মাটিগানটি গেয়েই সূচনা করেছিলেন ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রের ।' নিজের ঐন্দ্রজালিক কন্ঠ নিয়ে অন্য অনেকের মতই চলচ্চিত্র বা লঘু গান করে পরিবারের আর্থিক সুরাহা করতে পারতেন । নজরুল গানে নিবেদিতা ফিরোজা সে পথে যাননি । স্বামী কমল দাশগুপ্ত পঞ্চাশের দশকে সুরকার হিসাবে যার ভারতজোড়া খ্যাতি, প্রায় আট হাজার গানের সুরকার তাকে ঢাকায় মুদিখানার দোকান খুলতে হয়েছিল আর্থিক সংস্থানের জন্য । স্বাধীনতার পর, ১৯৭২এ বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে সে দেশে নিয়ে আসেন জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে । বাংলা দেশে নজরুল চর্চা গতি লাভ করে । গড়ে ওঠে নজরুল ইনস্টিটিউট যার ভাবনা ফিরোজা বেগমের । সেখানে ফিরোজা বেগম নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি প্রত্যয়ন বোর্ডেরও প্রধান হয়েছিলেন। ১৯৭৪এর ২০শে জুলাই নিতান্ত অনাদরে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় স্বামী কমল দাশগুপ্তর আর গত ৯ই সেপ্টেম্বর চলে গেলেন একহাজার ছশ গান করা এই প্রবাদপ্রতীম সংগীত শিল্পী ৮৪ বছর বয়সে ।

    দীর্ঘ সংগীত জীবনে অনেক সম্মাননা  পেয়েছেন তেমনভাবে প্রচারের আলোয় না থাকা ফিরোজা । কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই তাঁর শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান বিশ্বের অগণিত বাঙ্গালীর হৃদয়ে নজরুল-গানের কিংবদন্তী, ‘গানের পাখিহয়ে তাদের হৃদয়ে বিরাজ করা ।

    গত শতকের তিরিশের দশকে দেখেছি বাংলা গানের বিপুল বৈভব । বেতার ব্যবস্থার কল্যানে বাঙালির সঙ্গীতরুচি তৈরি হয়েছে  বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ নানান ধারার গানের সমাবেশে এই সময়কালে । সুতরাং বাংলা গানের এক অলিখিত বর্গীকরণ চালু করলো রেডিও । ১৯৩০এ ডাকা রেডিও ‘আধুনিক বাংলা গান’ কথাটি চালু করলো কিছু গানের ক্ষেত্রে । কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত, ভক্তিগীতি ইত্যাদি ধারার গানগুলিকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায় । কিন্তু আধুনিক বাংলা গান বলব কোনগুলিকে সে বিতর্ক থেকে যায় । কীর্তন বাঙ্গালির আদি গান এবং নিশ্চিতভাবেই ভক্তিগীতি । ভজনও ভক্তিগীতি । আগামী পর্বে ছুঁয়ে যাবো ভজন গানকে ।

(আগামীপর্বে আধুনিক মীরা বাঈ :যুথিকা রায় )

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ১৬

  অন্য ধারার গান : গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী     গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীতধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কা...