বাংলা থিয়েটারের আদিপর্ব ও নটী বিনোদিনী

 বাংলা থিয়েটারের আদিপর্ব ও নটী বিনোদিনী

 

 পুরুষতান্ত্রিক আমাদের সমাজে সমাজ প্রগতির প্রক্রিয়ায় নারীর অবদানকে যোগ্য স্বীকৃতি কোনদিনই দেয় না । বাংলা থিয়েটারে আদিপর্বে এক বারাঙ্গনা কন্যা তাঁর তন্ময় সাধনায় ও মেধায় সেকালের অভিনয় জগতের সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠেছিলেন ও বাংলা থিয়েটারের নির্মাণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছিলেন তার স্বীকৃতিও এই সমাজ দেয় নি । তিনি বিনোদিনী দাসী বা নটী বিনোদিনী । অন্যরকম ভাবে বাঁচার তাগিদে পিতৃপরিচয় হীনা বিনোদিনী থিয়েটারকেই তাঁর মুক্তিতীর্থ ভেবেছিলেন, প্রবল বঞ্চনা ও ছলনার শিকার হয়ে খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও মাত্র ২৩ বছর বয়সে চিরতরে মঞ্চত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন । আশার কথা তাঁর জন্মের সার্ধশত বর্ষে এই মহিয়সী রমণীকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাঁর জীবনকাহিনি আমরা জানতে চাইছি ।

১৮৭৪এর শেষের দিক, তখন বাংলা থিয়েটারের নিতান্ত শৈশবকাল । ঠিক দুবছর আগে ১৮৭২এর ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছে দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীল দর্পন’ নাটক দিয়ে । তার আগে কলকাতার ধনাঢ্য বাবুদের বদান্যতায় জমিদার বাবুদের আঙ্গিনায় সখের থিয়েটার হত মাঝে মধ্যে । কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তখন কলকাতার নতুন বিনোদন থিয়েটার দেখার সুযোগ ছিল না ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাধারণের জন্য থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল ।  কিন্তু নাটকের নারী চরিত্র রূপায়ন করতেন পুরুষ অভিনেতারাই১৮৭৩এ বেঙ্গল থিয়েটারে চারজন বারাঙ্গনা কন্যাকে অভিনেত্রী নিয়োগ করেছিলেন। মেয়েদের কাছে নাট্যাভিনয়ের দরজা খুলে গেলো সেই প্রথম, যে কাজের অক্লান্ত সৈনিক ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত । মধুসূদনের বেঙ্গল থিয়েটারে নাটক দেওয়ার শর্তই ছিল নারীচরিত্রে অভিনয় মেদের দিয়েই করাতে হবে । ১৮৭৩ সালের ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা  নাটকটি দিয়ে বাংলা নাট্যাভিনয়ে অভিনেত্রী নিয়োগের ধারাবাহিকতার সূচনা হয় । এই যুগান্তকারী ঘটনাটি অবশ্য দেখে যেতে পারেননি মধুসূদন, তার আগেই মৃত্যু হয় বাংলা থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের পক্ষে অক্লান্ত সৈনিক মাইকেল মধসূদন দত্তর (২৯জুন ১৮৭৩)  বিনোদিনীরা কোন প্রাপ্তির আশায় এসেছিলেন থিয়েটারে ? শুধুই কি অর্থ আর প্রতিপত্তি ?  তাহলে বিনোদিনী গুর্মুখ রায়ের কামনার আগুনে নিজেকে সঁপে দেওয়ার বিনিময়ে অভিনয় শিল্পীদের নিজস্ব থিয়েটার বানানোর স্বপ্ন দেখবেন কেন ?

১৭৯৫এ গেরেসিম লেবেডেফ প্রথম বাংলা নাট্যাভিনয়ের সূচনা করেন । বলা যায় নাট্যাভিনয়ে মেয়েদের অধিকারের একটা সূত্রপাতও হয়েছিল এই সুবাদেলেবেডের তার ভাষা শিক্ষক গোলকনাথ বসুর মাধ্যমে বারাঙ্গনা পল্লী থেকে তিনজনকে অভিনয় করিয়েছিলেন তার নাটকে । তারপর দীর্ঘ সময় বাংলা নাটকের অভিনয়ের কোন তথ্য পাওয়া যায় না । ১৮৩৫এ শ্যাম বাজারে বাবু নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে নাট্যাভিনয়ে বারাঙ্গণা পল্লী থেকে অভিনেত্রী সংগ্রহ করা হয়েছিল । কিন্তু পরবর্তী কালে ১৮৭৩ পর্যন্ত সমাজ অনুশাসনের প্রবল চাপে থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায় । ১৮৭২এ বাংলার প্রথম সাধারণ রঙ্গালয়ে সাড়া জাগানো নীলদর্পননাটকেও নারী চরিত্রগুলি পুরুষরাই অভিনয় করেছিলেন ।

মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন । তাদের একটা তাগিদ ছিল মুক্তির তাগিদ । থিয়েটারকে তাই তারা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, থিয়েটারকে ভালোবেসে পবিত্র হতে চাইলেন । এই পথ ধরে বিনোদিনীও এলেন থিয়েটারকে ভালোবাসতেবারো বছরের বালিকা বিনোদিনী দশটাকা মাস মাইনেতে ভর্তি হয়ে গেলেন গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে, নাট্যশিক্ষক অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি । ১৮৭৫এর শুরুতে অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফির পরিচালনায় গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার লখনৌ, লাহোর দিল্লী প্রভৃতি স্থানে অভিনয় করে নীলদর্পন, সুরেন্দ্রবিনোদিনী, সতী কি কলঙ্কিনী, গজানন্দ ও যুবরাজ প্রমু্খ ইংরাজ বিরোধী নাটক । বিনোদিনীও সেই দলে ছিলেন । তাঁদের নাটকেই ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরাজ শাসন জারি করে কুখ্যাত নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন । গ্রেট ন্যাশানাল বন্ধ হয়ে যায়, বিনোদিনী যোগ দেন বেঙ্গল থিয়েটারে । এখানে বিনোদিনী অভিনয় করলেন ‘মেঘনাদ বধ’ নাটকে প্রমিলা  ‘দুর্গেশ নন্দিনী’’তে আয়েষা, ‘কপাল কুণ্ডলা’ প্রমুখ দুরূহ চরিত্রে । বেঙ্গল থিয়েটারে বিনোদিনী অভিনয় করেছিলেন মাত্র উনিশ মাস আর এই অল্প সময়েই সেকালের সব প্রধান নাট্যকারের নাটকের মুখ্য ভুমিকায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন বিনোদিনীনজরে পড়েন গিরিশ চন্দ্র ঘোষের । গিরিশ চন্দ্র ঘোষ তাঁকে নিয়ে আসেন নিজ মালিকানাধীন ন্যাশানাল থিয়েটারে । চারবছর পরেই গিরিশ চন্দ্রের ন্যাশানাল থিয়েটারের মালিকানা বদল হয় । হীরা জহরতের ব্যবসায়ী মাড়োয়ারি যুবক প্রতাপ চাঁদ জহুরী থিয়েটার ব্যবসায়ে নামেন ও ন্যাশানাল থিয়েটার কিনে নেনগিরিশচন্দ্র চাকুরী ছেড়ে পেশাদার বেতন ভোগী ম্যানেজার হন । গিরিশচন্দ্রকে সামনে রেখেই প্রতাপ জহুরীর থিয়েটার ব্যবসায়ে নামা । প্রতাপ জানতেন গিরিশচন্দ্র থাকা মানেই বিনোদিনীর থাকা । কেননা ইতিমধ্যেই বিনোদিনীর অভিনয়ই তখনকার নাট্যজগতের প্রধানতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল । বস্তুত, এই সময় থেকে বাংলা থিয়েটার তার শৈশব কাটিয়ে পুরো মাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিলবিনোদিনীর বারো বছরের অভিনয় জীবনের নয় বছরই কেটেছে গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে, অভিনয় করেছেন ৯৬টি নাটকে বিনোদিনীর নিজের কথায় - “তাঁহার শিক্ষায় আমার যৌবনের প্রথম হইতে জীবনের সার ভাগ অতিবাহিত হইয়াছে” অর্থাৎ বাংলা থিয়েটারের উদ্ভব পর্বের শৈশব অবস্থা থেকে পেশাদারী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বিনোদিনীর যোগদান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল । বিনোদিনীকে বাদ দিয়ে ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই একযুগের বাংলা থিয়েটারের কোন আলোচনা করা যায় না ।

কত বড় অভিনেত্রী ছিলেন বিনোদিনী সেকথা বর্ণণা করা এখন স্বভাবতই অসম্ভব । আমাদের নির্ভর করতে হবে সেযুগের সামান্য কয়েকটি পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে যেটুকু উল্লেখ পাওয়া গেছে তার ওপর । এব্যাপারে নিশ্চিত ভাবেই বিনোদিনীর নাট্যশিক্ষক গিরিশ চন্দ্র ঘোষের মূল্যায়ন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । দুটি কথা এ বিষয়ে আমরা মনে রাখবো । এক, এগারো বছরের বালিকা বিনোদিনী যখন থিয়েটারে প্রবেশ করলেন তখন সবে মাত্র থিয়েটারে নারী চরিত্র নারীদের দিয়ে রূপায়ন করা শুরু হয়েছে । সুতরাং বিনোদিনীর সামনে অভিনয়ের কোন অনুসরণযোগ্য আদর্শ ছিল না । তাকে শুরু করতে হয়েছিল শূণ্য থেকে । দ্বিতীয়ত, সেকালের অভিনেত্রীরা বারাঙ্গনা হওয়ার কারণে পত্র-পত্রিকাগুলিতে তাদের অভিনয়ের আলোচনা কদাচই থাকতো । বিনোদিনীর প্রথম অভিনয় ১৯৭৪এর ১২ই ডিসেম্বর, গিরিশচন্দ্রের শত্রু সংহারনাটকে একটি অপ্রধান চরিত্র দ্রৌপদির সখির ভূমিকায় । মাত্র চার পাঁচটি সংলাপ । মাত্র তিনমাস পরেই ১৮৭৫এর ৬ই মার্চ হেমলতানাটকের নামভুমিকায় এবং ঐ বছরেই মার্চ থেকে মে পর্যন্ত অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির পরিচালনায় লক্ষ্ণৌ ও লাহোরে আটটি নাটক সতী কি কলঙ্কিনী ?’, ‘নবীন তপস্বিনী’, ‘সধবার একাদশী’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’, ‘লীলাবতী’, ‘নীলদর্পণনাটকে প্রধান নারী চরিত্র অভিনয় করেন । অতয়েব আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না অভিনয় দক্ষতার জন্যই মাত্র একবছরের মধ্যে নাটকের ক্ষেত্রে বিনোদিনী কত অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন ।

সেকালের সমস্ত প্রধান নাট্যকারের সব নাটকেই প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন বিনোদিনী । বিনোদিনী অভিনীত নাট্য চরিত্রগুলির ওপর চোখ বোলালেই বোঝা যাবে সেযুগের নাটকে বিনোদিনীর অভিনয় তাঁর অপরিহার্যতার কথা অসামান্য অভিনয় দক্ষতা না থাকলে নিশ্চিত ভাবেই সেই সব দুরূহ চরিত্রে বিনোদিনীকে নির্বাচিত করতেন না । সেকালের কয়েকটি প্রসিদ্ধ নাটকের বিনোদিনী অভিনীত চরিত্র এই রকম

সরোজিনী                     নাম ভূমিকা

দুর্গেশ নন্দিনী              আয়েষা

মেঘনাদ বধ                প্রমীলা

মৃণালিনী                      মনোরমা

কপাল কুন্ডলা             কপাল কুন্ডলা

বিষবৃক্ষ                        কুন্দনন্দিনী

বুড়ো  শালিকের             ফতি

ঘাড়ে রোঁ     

শরৎ-সরোজিনী             সরোজিনী

রাবণবধ                       সীতা

দক্ষযজ্ঞ                        সতী

নল-দময়ন্তী                  দময়ন্তী

শ্রীবৎস চিন্তা                চিন্তা

প্রহ্লাদ চরিত্র                 প্রহ্লাদ

চৈতন্যলীলা                  নিমাই

বিল্বমঙ্গল                     চিন্তামণি

 

বিনোদিনী তাঁর ১২বছরের নাট্যজীবনে চারটি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন গ্রেট ন্যাশানাল’ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’, ‘ন্যাশনাল থিয়েটারস্টার থিয়েটার নাট্য শিক্ষক পেয়েছিলেন অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি(গ্রেট ন্যাশানাল) শরৎচন্দ্র ঘোষ (বেঙ্গল) এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ (ন্যাশানাল ও স্টার থিয়েটার) বেঙ্গল থিয়েটারে দু বছর থাকা কালীন বিনোদিনী যথার্থ পরিণত হয়ে উঠেছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনীতে মনোরমা’, ‘কপাল কুন্ডলা’,দূর্গেশ নন্দিনীর ‘আয়েষা’ ও ‘তিলোত্তমা’, মেঘনাদ বধএ ‘প্রমীলা’র মত জটিল চরিত্রের অভিনয়ে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছিলেন । মৃণালিনীতে মনোরমার জটিল চরিত্রটিকে বিনোদিনী কেমন বিশ্লেষণ করেছিলেন সেকথা আত্মকথায় লিখে গেছেন “একসঙ্গে বালিকা,প্রেমময়ী যুবতী, পরামর্শদাতা, মন্ত্রী, অবশেষে পরম পবিত্র চিত্তে স্বামী সহ-মরণ অভিলাষিনী দৃঢ়চেতা এক রমণী”বিনোদিনী তখন ১৪বছরের বালিকা । এমন বিশ্লেষণই বলে দেয় তাঁর অভিনয় প্রতিভার গভীরতা । স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র মৃণালিনীর অভিনয় দেখে মন্তব্য করেছিলেন “আমি মনোরমার চিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে প্রত্যক্ষ করিব এমন আশা করি নাই । আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল

গিরিশচন্দ্রের সংস্পর্শেই বিনোদিনীর অভিনয় সম্রাজ্ঞীতে উত্তরণ । গিরিশচন্দ্র স্বয়ং লিখেছেন আমি মুক্তকন্ঠে বলিতেছি যেরঙ্গালয়ে বিনোদিনীর উৎকর্ষ আমার শিক্ষা অপেক্ষা তাহার নিজগুনে অধিক , সূর্যরশ্মিকে প্রতিফলিত করতে মণি খন্ডের প্রয়োজনবিনোদিনীর মত সহ-অভিনেত্রী না পেলে গিরিশ চন্দ্রের প্রবাদ প্রতীম নাট্যপ্রতিভার পূর্ণ ব্যাপ্তী ঘটতো না, একথা স্বয়ং গিরিশচন্দ্রও স্বীকার করে গেছেন । বিনোদিনীর আত্মকথার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র, সেখানে তিনি স্বীকার করেছেন তাহার সর্বতোমুখী প্রতিভার নিকট আমি সম্পূর্ণ ঋণী একথা স্বীকার করিতে আমি বাধ্য ...অভিনয় করিতে করিতে সে তন্ময় হইয়া যাইত, আপন অস্তিত্ব ভুলিয়া এমন একটি অনির্বচনীয় পবিত্র ভাবে উদ্দীপ্ত হইয়া যাইত, সে সময় অভিনয় অভিনয় বলিয়া মনে হইত না, যেন সত্য ঘটনা বলিয়াই অনুভূত হইত

বিনোদিনী তাঁর বারো বছরের অভিনয়জীবনের নয়বছরই কাটিয়েছেন গিরিশচন্দ্রের সংস্পর্শে, আর এই সময়কালেই তিনি অভিনয় দক্ষতার শিখর স্পর্শ করেছিলেনসেকালীন বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী ছিলেন শুধু তাই নয়, বিনোদিনীর অভিনয় বাংলা থিয়েটারকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল । সেকালের সমাজ নাট্যাভিনয়কে সম্মানের কাজ বলে মনে করতো না । সম্ভ্রান্ত মানুষজন থিয়েটার থেকে দূরেই থাকতেন । মঞ্চ থেকে সরে যাওয়ার দুবছর আগে আলোড়ন সৃষ্টিকারী চৈতন্যলীলানাটকে নিমাই চরিত্রের অসামান্য অভিনয় থিয়েটারের সঙ্গে সেকালীন সমাজের ব্যবধানের বেড়া ভেঙ্গে দিয়েছিল । বিনোদিনীর অভিনয় দেখতে আসেন শ্রীরামকৃষ্ণ দেব । বিনোদিনীর নিমাই চরিত্র চিত্রন দেখে ভাববিহ্বল রামকৃষ্ণদেব বিনোদিনীর অভিনয়ের মধ্যে দেখতে পান আসল আর নকল যেন এক থিয়েটারে পদার্পন করে থিয়েটারে লোক শিক্ষে হয়বলে বার্তা দিলেন রামকৃষ্ণ দেব  চৈতন্য লীলার নিমাই চরিত্রের অভিনয়ে তিনি কি তন্ময় সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সেকথা বিনোদিনী নিজেই লিখে গিয়েছেন । গিরিশ রচনাবলীর ৩য় খন্ডের পরিশিষ্টে গিরিশচন্দ্র বিনোদিনীর কথা উদ্ধৃত করেছেন লিখছেন চৈতন্য লীলা রিহার্শালের সময় অমৃতবাজার পত্রিকার এডিটর বৈষ্ণব চূড়ামণি শ্রীযুক্ত শিশির বাবু মহাশয় মাঝে মাঝে যাইতেন এবং আমার ন্যায় হীনা দ্বারা সেই দেব চরিত্র যতদূর সম্বব সুরুচি সংযুক্ত হইয়া অভিনয় হইতে পারে তাহার উপদেশ দিতেন, এবং বারবার বলিতেন আমি যেন সতত গৌর পাদপদ্ম হৃদয়ে চিন্তা করি । আমিও তাঁর কথামত মহাপ্রভুর পাদপদ্ম চিন্তা করিতাম ...যেদিন চৈতন্য লীলাপ্রথম অভিনয় করি, তাহার আগের রাত্রে প্রায় সারা রাত্রি নিদ্রা যাই নাই; প্রাণের মধ্যে একটা আকুল উদবেগ হইয়াত যে কেমন করিয়া এই অকুল পাথারে কুল পাইব । প্রাতে উঠিয়া গঙ্গা স্নানে যাইলাম; পরে ১০৮ দুর্গানাম লিখিয়া তাঁহার চরণে ভিক্ষা করিলাম ... আমি যেন তাঁর কৃপা লাভ করি । ... আমি মনে মনে বুঝিতে পারিলাম যে ভগবান আমায় কৃপা করিতেছেন । কেননা সেই বাল্যলীলার সময় রাধা বই আর নাইকো আমার, রাধা বলে বাজাই বাশি-  বলিয়া গীত ধরিয়া যতই অগ্রসর হইতে লাগিলাম ততই যেন একটা শক্তিময় আলোক আমার হৃদয়কে পূর্ণ করিয়া তুলিতে লাগিল ...শেষে সন্যাসী হইয়া সংকীর্তন কালে হরি মন মজায়ে লুকালে কোথায় / আমি ভবে একা দাও হে দেখা প্রাণ সখা রাখো পায়এই গানটি গাহিবার সময়ের মনের ভাব আমি লিখিয়া জানাইতে পারিব না। আমার তখন মনে হইত যে আমি তো ভবে একা , কেহ তো আমার আপনার নাই ! উন্মত্ত ভাবে সংকীর্তনে নাচিতাম , এক এক দিন হইত যে অভিনয়ের গুরুভার সইতে না পারিয়া মুর্ছিতা হইয়া পড়িতাম এমন অনন্য অভিনয় প্রতিভায় শ্রীচৈতন্য দেব চরিত্রাভিনয়ের মধ্য দিয়ে বিনোদিনী গ্লানিহীন হতে চেয়েছিলেন । রামকৃষ্ণদেবের আশির্বাদে বিনোদিনীর কলুষমুক্তি ঘটলো আর বঙ্গ রঙ্গালয় থেকেও অশুচিতার বেড়া ভেঙ্গে দিলেন বিনোদিনী । বিনোদিনীর মঞ্চ ত্যাগের পর গিরিশচন্দ্রের মত মহা শক্তিধর নাট্য পরিচালকও চৈতন্যলীলাআর মঞ্চস্থ করতে পারেন নি ।

 

এহেন বাংলা থিয়েটার বিনোদিনীকে মনে রাখেনি । বিনোদিনীকে পাওয়ার লোভে গুর্মুখ রায় মুসাদ্দি নামে এক মাড়োয়ারি যুবক থিয়েটারের ব্যবসায়ে নামেন । তিনি একটি থিয়েটারবাড়ি নির্মাণ করে দেবেন, কিন্তু গিরিশ চন্দ্রদের শর্ত দিলেন বিনোদিনীকে তাঁর রক্ষিতা হয়ে থাকার জন্য রাজি করাতে হবে, আর থিয়েটার হবে বিনোদিনীর নামে । নিজেদের থিয়েটার হবে, শিল্পীদের থিয়েটার হবে, থিয়টার হবে তাঁর নামে এই প্রতিশ্রুতিতে বিনোদিনী সম্মত হয়েছিলেন গিরিশ চন্দ্রদের প্রস্তাবে । নানা গন্ডগোলের কারণে গুর্মুখ রায় থিয়েটার বাড়ির বদলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন বিনোদিনীকে । বিনোদিনী নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভ হেলায় ত্যাগ করেছিলেন বলেছিলেন থিয়েটার বাড়ি নাহলে তিনি গুর্মুখের সঙ্গিনী হবেন না । দেড়শ’ বছর আগে পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভ হেলায় ত্যাগ করেছিলেন যিনি, তাঁকে প্রতারিত হতে হ’ল তাঁর সহ অভিনেতা নাট্যরথীদের  কাছ থেকে । বাংলা পেশাদারী থিয়েটারের উদ্ভব কালের সে এক ক্লেদাক্ত ঘটনা ।

বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় লিখে গিয়েছেন “শীঘ্র শীঘ্র প্রস্তুতের জন্য রাত্র পর্যন্ত কার্য হইত । সকলে চলিয়া যাইতেন । আমি, গুর্মুখ বাবু আর দুএকজন রাত্রি জাগিয়া কার্য করাইয়া লইতাম” থিয়েটার বাড়ি হল , কিন্তু গুর্মুখ রায় বা বিনোদিনীর অজান্তে গিরিশ বাবুরা সেই থিয়েটারের রেজিস্ট্রী করে নিলেন বি- থিয়েটার নয় ‘স্টার থিয়েটার’ নামে’ বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় লিখে গিয়েছেন “আমি তখন একেবারে উহাদের হাতের ভিতর! আর আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই যে উহারা ছলনা দ্বারা আমার সহিত এমনভাবে অসৎ ব্যবহার করিবেন” এই প্রবঞ্চনা সত্তেও থিয়েটারের প্রতি তাঁর ভালোবাসার জন্য বিনোদিনী স্টার থিয়েটারেই থেকে গিয়েছিলেন । ১৮৮৩র ২১শে জুলাই স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হয় গিরিশ চন্দ্রের ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটক দিয়ে , সতীর ভুমিকায় বিনোদিনী । মাত্র ছয়মাস পরেই অসুস্থতা ও পারিবারিক চাপে গুর্মুখ থিয়েটার ব্যবসা ত্যাগ করেন । গুর্মুখ চেয়েছিলেন যার জন্য তিনি থিয়েটার বানিয়েছিলেন সেই বিনোদিনীকে থিয়েটারের স্বত্ব দিয়ে যেতে । এবারেও গিরিশ বাবুরা বাধা দিলেন । সরলমতী থিয়েটারে নিবেদিতপ্রাণা বিনোদিনী আবারও বঞ্চিত হলেন । মাত্র এগারো হাজার টাকায় স্টার থিয়েটার কিনে নিয়েছিলেন অমৃতলাল মিত্র, দাশুচরণ নিওগীরা । কেন এই প্রতারনা ? সেকালের নাট্যরথীরা বলেছিলেন এক বারাঙ্গনা কন্যার নামে থিয়েটার সেযুগের সমাজ মেনে নিত না , থিয়েটার চলতো না ।

অথচ এই বারাঙ্গনা কন্যার অভিনয়ই সেদিন বাংলা থিয়েটারকে মর্যাদামন্ডিত করেছিল । ১৮৮৪’র ২রা অগস্ট গিরিশচন্দ্রের ‘চৈতন্য লীলা’য় নিমাই চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয় দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ভাববিহ্বল হয়ে পড়েন, বিনোদিনীর মস্তক স্পর্শ করে আশির্বাদ করেনথিয়েটারে অশুচিতার বেড়া ভেঙ্গে যায় । ১৮৮৬র ১৬ই অগস্ট রামকৃষ্ণ দেবের মৃত্যু , আর তার চারমাস পরেই একরাশ ক্ষোভ ও যন্ত্রণা নিয়ে অভিনয় খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও ১৮৮৭র ১লা জানুয়ারী থিয়েটার ত্যাগ করেন মাত্র ২৩ বছর বয়সে । আর ফিরে আসেন নি । বিস্ময়ের কথা, মঞ্চ ত্যাগের পর আরো পঞ্চান্ন বছর বেঁচে ছিলেন বিনোদিনী । বৃদ্ধ বয়সেও স্টারে থিয়েটার দেখতে আসতেন । কিন্তু গিরিশবাবুরা এই অসামান্য অভিনয় শিল্পীকে মঞ্চে ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি । আসলে বিনোদিনীর অসামান্য অভিনয় প্রতিভা ও প্রবল ব্যক্তিত্ব সেকালের নাট্যরথীরা উপেক্ষাই করতে চেয়েছিলেন ।

সেকালের সব অভিনেত্রীই আসতেন বারাঙ্গনা পল্লীথেকে, যারা সকলেই বাংলা থিয়েটারে নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন, বাংলা থিয়েটারকে মর্যাদামন্ডিত করেছেন, তাদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকুও এই সমাজ দেয় নি । গিরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহে মালা দেবার অধিকারটুকুও তাদের দেওয়া হয়নি ।

বিনোদিনী সংসার করতে চেয়েছিলেন । তার গর্ভে পিতৃপরিচয়হীন যে কন্যাসন্তান জন্ম নিয়েছিল, বিনোদিনী তার নাম রেখেছিলেন শকুন্তলা । থিয়েটার ত্যাগ করার পর জনৈক সমভ্রান্ত জমিদার বিনোদিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং তাঁর আশ্রয়েই দাম্পত্য জীবনেরও স্বাদ পেয়েছিলেন । কিন্তু বিনোদিনী কোনদিন সেই মানী ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করেন নি যেমন, তিনি যে বারাঙ্গনা কন্যা সে কথাও তাঁর আত্মজীবনীতে গোপন করার কোন চেষ্টা করেন নি ।

রঙ্গালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের ছাব্বিশ বছর পরে,তখন তাঁর বয়স ৪৯ বছর বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী । ‘আমার কথা’ গ্রান্থাকারে প্রকাশ করেন । তার আগে এবং পরেও বিনোদিনীর লেখনি চর্চা অব্যাহত ছিল । প্রকাশ করেছিলেন এবং বাসনা এবং ‘কনক ও নলিনী’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ । কিন্তু বাংলা সাহিত্যের  প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদা কিংবা দুটি কাব্যগ্রন্থের লেখিকার মর্যাদা বিনোদিনী পান নি । বারারাঙ্গনা কুলোদ্ভবা যে !

বিনোদিনীর কন্যা সন্তানকেও সমাজপতিরা বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে বাধা দিয়েছিলেন, সমাজের মানী লোকেরা তাঁর অভিনয় দেখার জন্য রাতের পর রাত প্রেক্ষাগৃহে ছুটে যেতেন, তাঁকে ধন্যধন্য করতেন । কিন্তু তখনকার সমাজের মানী লোকেরা তার কন্যাকে বিদ্যালয়ে ভর্তিতে বাধা দিলেন । বিনোদিনী পারেননি তার কন্যা শকুন্তলাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে । আত্মকথায় বিনোদিনী এক যায়গায় একটি বাক্য লিখেছিলেন “নারীর নিস্তার নাই টলিলে চরণ” না সেদিন ছিল না, আজও নেই ।

৭৯বছর বয়সে ১৯৪১এর ১২ই ফেব্রুয়ারি জন্মস্থান ১৪৫নম্বর কর্নোয়ালিশ স্ত্রীটের বাসায় নিভৃতে তাঁর মৃত্যুকালে বাঙালির সমাজ যদিও অনেক উদার, কিন্তু অন্ধকার জগত থেকে উঠে আসা , আমাদের থিয়েটারের নির্মাণে অসামান্য অবদান রেখে যাওয়া এক নটীর মৃত্যুতে কোন শোকসভা হয়নি । কোন সংবাদপত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল কি না জানা নেই । তাঁর একটি কবিতার পংক্তিতে “স্মৃতি হতে বিস্মৃতিতেই অধিক সন্তোষ” মনে করেছিলেন বিনোদিনী । দেড়শ বছর পর আমরা কিন্তু ইতিহাসের সেই ছিন্নপত্র সন্ধান করে বেদনাহত হয়ে যাই ।   

                                               =============

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ১৬

  অন্য ধারার গান : গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী     গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীতধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কা...