বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ১৬

 অন্য ধারার গান : গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী

    গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীতধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কাব্যসঙ্গীতের স্বর্ন সময়ে, তার পোষাকি নাম গণসঙ্গীতকোন গান গণসঙ্গীত কোনটা নয় এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে । প্রয়াত সলিল চৌধুরীর কথায় শ্রমজীবি মানুষের আশা-আকাংখ্যার ইতিহাস হল গণসঙ্গীতহেমাঙ্গ বিশ্বাস স্পষ্ট করেছিলেন এভাবে –“স্বাদেশিকতার ধারা সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার সাগরে গিয়ে মিশেছে সেই মোহনায় গণসংগীতের জন্মআবার কেউ বলেন গণসঙ্গীত শুধুমাত্র সংগীতের একটি প্রবল ধারা নয়, গণসংগীত ধরে রাখে ইতিহাসের এক বিশেষ প্রতিবাদী পর্যায়

    গত শতকের চল্লিশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত সময়কালের বাংলা গানে অবশ্যই একটা নতুনতর মাত্রা যোগ করেছিল এই ধারার গান । সেই সময়কালে গুরুদাস পাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নিবারণ পন্ডিত, সলিল চৌধুরী, রমেশ শীল, দিলীপ সেনগুপ্ত প্রমুখ বাংলা গানের ভান্ডারে অনেক মণিমুক্ত রেখে গেছেন । সহজবোধ্য কারণেই গ্রামফোন কোম্পানী এই ধারার গানকে বিপননযোগ্য মনে করেনি । তুলসী লাহিড়ীর কথা ও সুরে কমলা ঝরিয়া মার্চ ১৯৪৬-এ মেগাফোন থেকে দুটি গান রেকর্ড করেন : শোন্ রে শোন্ বাংলা দেশের কাঙ্গাল চাষী ভাইএবং ভুলো না রেখ মনে বাঁচবে যত কাল/ সোনার দেশে কেন এল পঞ্চাশের আকালস্মরণে আছে, ১৯৪৮ সালে  গণনাট্য সঙ্ঘের সমবেত সঙ্ঘসঙ্গীত এসো মুক্ত করোকলম্বিয়া লেবেলে রেকর্ড করেছিল । শুরুর পর্বে দেবব্রত বিশ্বাস হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ যশস্বী শিল্পীরা গণনাট্য সঙ্ঘের মঞ্চে সামিল হয়েছিলেন । চল্লিশের দশকটা ছিল এক উত্তাল সময়কাল , মানবতাধ্বংসি ফ্যাসিবাদের  উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তরে নিরন্ন মানুষের হাহাকার, সেই সময়টা সাহিত্যে কবিতা গান নাটকেরও মহাজাগরণকাল । ১০৪৬র ডাক ও তার ধর্মঘটের প্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরীর অসামান্য সঙ্গীত সৃজন রাণার’, যেটি পরে গ্রামফোন রেকর্ডে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন । এই গানটি শোনেননি এমন বাঙালি সম্ভবত এমন কেউ এই প্রজন্মেও নেই । ১৯৪৮ সলিল চৌধুরীর কালজয়ী সঙ্গীতসৃজন কোন এক গাঁয়ের বধু’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কবিতার সঙ্গীতায়ন পালকীর গান’, তারপর একেরপর এক সলিল - হেমন্তর যুগলবন্দী ধান কাটার গান’, ‘নৌকা বাওয়ার গান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ঠিকানা’, হেমন্ত-লতার দ্বৈত কন্ঠে দে দোল দোল’, বাদল কালো ঘিরলো গো’, সুবীর সেনের ঐ উজ্বল দিনএই সব গান গণসঙ্গীতের তকমা না নিয়েও লোকের মুখে মুখে ফিরেছে । বাংলায় গণসংগীত পুষ্ট হয়েছে সমাজ বদল ভাবনার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে । গণসংগীত তার নিজস্ব শক্তিতে এখনও মানুষকে আন্দোলিত করে, পীড়িত মানুষের বেদনার কেন্দ্রে হাত রাখে, যুথবদ্ধ মানুষের আপন গান হয়ে ওঠে । গুরুদাস পাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, দিলীপ সেনগুপ্ত, অজিত পান্ডে  ভুপেন হাজারিকা থেকে রুমা গুহ ঠাকুরতা, সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়ার গান কিংবা একালের কল্যাণ সেন বরাটের বৃন্দগান, কিংবা প্রয়াত নরেন মুখোপাধ্যায়, শুভেন্দু মাইতি, পল্লব কীর্তনিয়া, কঙ্কণ ভট্টাচার্য প্রমুখের গান গণসঙ্গীত ধারাকেই পরিপুষ্ট করেছে । এইসব গানকে গণসংগীত বলি আর না বলি, মানুষ যে গানে তার প্রাণের ভাষা আর সুর খুঁজে পায়, যে গান তার সংগ্রামী চেতনাকে স্পর্শ করে তাইই গণ সঙ্গীত ।

    হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন, ‘গণসঙ্গীত মানুষের সচেতন জীবন সংগ্রামের ফসল। বলা যেতে পারে জাতীয় চেতনার ধারা যেখানে আন্তর্জাতিক, মেহনতী মানুষের আন্দোলনের সমুদ্রে মিশেছে সেই সাগর সঙ্গমে গণসঙ্গীতের উৎপত্তি’

গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ‘গণসঙ্গীত’ এর প্রচলিত ধারণাটি পুষ্ট হয়েছে, শুধুমাত্র শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার এমন ধারণাই পুষ্ট হয়েছে । তা কিন্তু নয় । যে গান গণমানুষের চেতনাকে উদ্দিপ্ত করে, গণমানুষের জীবনভাষ্য যে গানে তাইই গণসঙ্গীত । রবীন্দ্রনাথের অনেক দেশাত্মবোধক গান, নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘বল ভাই মাভৈ মাভৈ নবযুগ ঐ এলো ঐ’, কৃষ্ণুন্দ্র দে’র ‘মুক্তর মন্দির সোপান তলে’ ইত্যাদি নিশ্চিতভাবেই গণসঙ্গীত । গণসঙ্গীত ধারণার সূত্র রয়েছে আমাদের লোকগানের মধ্যে । লোকগানের সুর ও কথার উপাদান মানুষের জীবন ও যাপন, তার তার আনন্দ, পীড়া ও আকাঙ্খ্যা । লালন ফকিরের ভাবশিষ্য বিশ শতকের খ্যাতকীর্তি লোকসঙ্গীতকার শাহ আবদুল করিম বাউল, দেহতত্ব ধামাইল প্রভৃতি গানের সঙ্গে অনেক গণসঙ্গীতও রচনা করেছেন । খ্যাতকীর্তি কবিয়াল শেখ গুমানি দেওয়ান আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত কবিগান পরিবেশন করতেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে ওই চারণ কবি বারবার শান্তিনিকেতন গিয়ে কবিগুরুর সামনে কবিগান পরিবেশন করেছেন। তিনিও অনেক গণসঙ্গীত রচনা করেছেন ।

 

  

সলিল চৌধুরী

    বাংলা গানে নতুন দিগন্ত নিয়ে এসেছিল সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গীত! পঞ্চাশের মন্বন্তরে সলিল সৃষ্টি করলেন একের পর এক গান, ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’,‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপেতাঁর লেখা গণসংগীত অনুপ্রেরণা দিল ছাত্র-মজুর-কৃষকসহ সব অধিকার বঞ্চিতদের। এদেশ তোমার আমার/ আমরা ভরি খামার/ আমরা গড়ি স্বপন দিয়ে সোনার কামনায়কথা ও সুরের আবেদনে আর হেমন্ত মুখোপাধ্যেয়ের কন্ঠে সকলের গান হয়ে উঠল। গণসঙ্গীতের সর্বজনীন আবেদন বার বার এসেছে তাঁর গানের কথা আর সুরের মূর্ছনায়। মর্জিনা আবদাল্লার বাণিজ্যিক ছবির গ্ল্যামারাস গল্পেও কাঠুরিয়াদের গানে মাটির মানুষের টান- ও ভাইরে ভাই/ হে হে, আয় রে আয়/ আয়রে কুড়ুল করাত নিয়ে/ পোড়া বরাত নিয়ে/ জঙ্গলে জঙ্গলে আয় রে/ আয় রে কাটি কাঠ, কাটি কাঠ, কাটি কাঠ।চাঁদ ফুল জোছনা ছাড়াই, ‍‌প্রেমের গুন গুন গুঞ্জন বাদ দিয়েও, যে পথে নেমে মানুষের হাতে হাত রেখে বলা যায় পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি,’ দেখালেন সলিল চৌধুরী। আরও পরে ব‍‌লেছেন, ‘আমি পথ খুঁজি না তো, পথ মোরে খোঁজে।তাঁর সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলায় গলায় আয় বৃষ্টি ঝেঁপেকিংবা উজ্জ্বল, এক ঝাঁক পায়রা/ সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে/ চঞ্চল পাখনায় উড়ছেশুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। সলিল চৌধুরীর সুরে- ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা/ আমার হয় কি গো ভরসা/ আমার ভাঙা ঘরে তুমি বিনে’-তে খুঁজে পাই যেন অন্য ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে।

 

    গান আর সুর নিয়েই জন্মেছিলেন সলিল চৌধুরী। পৃথিবী তাঁকে মনে রাখে তাঁর সুরের জন্য। কিন্তু তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল নানা ধারায়। সেই অন্য দিকগুলো নিয়ে তেমন চর্চা হয় না। সুরকারসলিল চৌধুরীর প্রতিভার দীর্ঘ ছায়ায় বারবার ঢাকা পড়ে যান কবি সলিল, গল্পকার সলিল, চিত্রনাট্যকার সলিল। মুম্বই যাওয়ার ডাকও কিন্তু এসেছিল গল্পকার সলিলের কাছে। সলিল চৌধুরীর রিকশাওয়ালাগল্প নিয়ে ছবি করবেন বিমল রায়। ডাক পড়ল তাঁর। বন্ধু হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বিমল রায়কে বললেন, সলিল তো মূলত গান-বাজনারই লোক। ওকেই যদি দো বিঘা জমিন’-এর সঙ্গীতের দায়িত্ব দেওয়া হয়! খুব কম মানুষই জানেন দো বিঘা জমিন’-এর গল্পটি তাঁর লেখা। সূচনা হল সলিল চৌধুরীর নতুন যাত্রা। সলিল চৌধুরীর সুরে লতা মঙ্গেশকরের গলায় ও সাজনা বরখা বাহার আয়িআজও জনপ্রিয়। বিমল রায়ের ছবি পরখ’-এর গান। কিন্তু কজনই বা জানেন, এ ছবির গল্পটিও সলিলেরই? তাঁর কলমের জোর এতটাই ছিল যে মুম্বইয়ের মতো বিনোদনসর্বস্ব ফিল্ম জগতে দো বিঘা জমিন’, কিংবা পরখ’-এর মতো জীবনধর্মী কাহিনী ছবির পটভূমি হয়ে উঠেছিল। একটি হিন্দি ছবি পরিচালনাও করেছিলেন সলিল চৌধুরী। ছবির নাম পিঞ্জরে কে পঞ্ছিঅভিনয়ে মেহমুদ আর মীনাকুমারী। সেবার আর একটি ছবির গান তৈরি। পিকচারাইজেশনও শেষ। বিশিষ্ট কিছু মানুষের জন্য স্পেশাল স্ক্রিনিং হচ্ছে। ছবি শেষে শচীন দেব বর্মন এগিয়ে এসে বিমল রায়কে বললেন, “সলিলের এই গানগুলান ইতিহাস হইব, দেইখ্যা রাখেন।ছবিটি মধুমতী।এর পরের ঘটনা তো সকলের জানাসুপারডুপার হিট হয়েছিল মধুমতীর গান। বিমল রায় বলতেন, ‘সলিলের সুর তো ছবি আঁকে।সেসময় বিমল রায়ের সহকারী ছিলেন গুলজার। তিনি বলেছেন, সলিলদার লেখা বড়ই সিনেম্যাটিক। আসলে গল্প বলার একটা অসামান্য দক্ষতা ছিল ওঁর। কখনও তার প্রকাশ হত গানের কথায়, আবার কখনও বা গল্পে, কবিতায়। এ ব্যাপারে সলিল চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে নিজে বলেছেন, “আমি জানি না, কোনটা নিয়ে চলব: কবিতা, গল্প লেখা, অর্কেস্ট্রেশন, না ফিল্মের গান কম্পোজ করা। ক্রিয়েটিভিটি নিয়েই আমার কাজ। যখন যেটা সেই মুহূর্তটায় বা আমার মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খায়, সেটা নিয়ে কাজ করি।

 

    তবু, ‘মধুমতীর মতো এক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত কীর্তির পরেও মুম্বইয়ের বাজারে স্থায়ী জায়গা হয়নি সলিল চৌধুরীর। মধুমতী’, ‘আনন্দ’, বা পুনম কি চাঁদ’-এর মতো অসাধারণ স্বপ্নিল সুরে মুম্বইকে বেঁধে ফেলেও সেখানে সলিল চৌধুরীর পরিচয় আজও সেরা বাঙালি প্রতিভা হিসেবে। আনন্দ’-এ সলিলের সুরে কহি দূর যব দিন ঢল যায়েগেয়ে মুকেশ সেরা জাতীয় গায়ক হলেও সলিল চৌধুরীর পরিচিতি আঞ্চলিক। আর কলকাতা? সেও কি আপন করে নিতে পেরেছিল তাঁকে পুরোপুরি? তাহলে বাঙালি মনের গভীরে যাঁর সৃষ্টি দোলা দেয়, রবীন্দ্র-পরবর্তী অন্যতম সেই শ্রেষ্ঠ বাঙালি সুরকারটিকে এ রকম ছায়াচ্ছন্ন থাকতে হল কেন? বাকি জীবনেও এত লড়ে যেতে হল কেন! কলকাতা বুঝি তাঁকে ভেবে নিয়েছিল মুম্বইয়ের ফিল্ম জগতের পুরোধা। তাই বহু বছর পর মুম্বই থেকে কলকাতা ফিরেও তিনি ঘরেও নহে, পারেও নহেঅবস্থাতেই রয়ে গেলেন বাকি জীবনটুকু।

 

    আসলে অনেক কাজ একসঙ্গে করতে জানা অসীম প্রতিভাবানদের আমরাই হয়তো ঠিকমত বুঝে উঠতে পারি না। সলিল চৌধুরীকে অনেকেই বলতেন ইনটেলেকচুয়াল কম্পোজার। গান লেখা, সুর করা আর অ্যারেঞ্জ করা এই তিনটি কাজ এক সঙ্গে তিনি করেছেন। তিনটিতেই তিনি শ্রেষ্ঠ। আশ্চর্য সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন সুর নিয়ে, গায়ক-গায়িকাদের কণ্ঠ নিয়ে। একই গান হয়তো তিনটে ভাষায় গাওয়া হবে। মিউজিক কম্পোজ করার সময় সলিল তিনটে আলাদা অ্যারেঞ্জমেন্ট করতেন। বাংলা গানের সুরে হয়তো ফোকের ছোঁয়া। সেই একই গানের হিন্দি রূপান্তর হল ভীষণ সিডাকটিভ। আবার সেটাই যখন মালয়ালম হচ্ছে, পাল্টে গিয়ে হল সেখানকার মেছুনিদের লোকগান। তাঁর প্রত্যেকটি গানের ইন্টারলিউড একেবারে একটা আলাদা গান। সলিলের আকর্ষণ সুরের জটিল বিন্যাসে। তাঁর সুরের আরেক বৈশিষ্ট্য নোটেদের চলন- এই হয়তো রয়েছে তার সপ্তকের সা-তে, এই নেমে এল মধ্য সপ্তকের রে-তে। সুরের এই জটিলতার জন্যই সলিলের প্রয়োজন ছিল অনুশীলিত গলার। সলিল চৌধুরীর সুরে লতা মঙ্গেশকর এমন কিছু গান গেয়েছিলেন, যেগুলো বাংলা বা হিন্দি গানের অবয়ব বদলে দিয়েছিল। আবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠমাধুর্য ও গায়কীর খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে কতটা অনুরাগী ছিলেন সলিল চৌধুরীর সুরের, তার প্রমাণ মেলে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তিতে, যখন বলেন- যাঁদের সুরে আমি গান গেয়েছি, তাঁদের মধ্যে আমার গলাটাকে সব থেকে সার্থক ভাবে ব্যবহার করেছে সলিল।রবীন্দ্রশতবর্ষে, ১৯৬১-তে সলিল চৌধুরী সৃষ্টি করলেন- আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।পরে বলেছেন, ‘গানটাতে নিজের জীবনের ছোঁয়াই একটু রাখতে চেয়েছি, যখন বলছি আমি আবার কাঁদব হাসব এই জীবন জোয়ারে ভাসব/আমি বজ্রের কাছে মৃত্যুর মাঝে/রেখে যাব নিশানা।

 

কবি সলিল চৌধুরীকেও কি ভোলা যায়? সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আমরা তো অনেক রঙিন বিপ্লবের কবিতা লিখেছি। কিন্তু শপথলিখে সলিল বুঝিয়ে দিয়েছে ও কত বড় মাপের কবি...

সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল

তাই

গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে তৈরী হও

কার ঘরে জ্বলেনি দীপ চির আঁধার তৈরী হও

কার বাছার জোটেনি দুধ শুকনো মুখ তৈরী হও

ঘরে ঘরে ডাক পাঠাই তৈরী হও জোটবাঁধো

মাঠে কিষান কলে মজুর নওজোয়ান জোট বাঁধো...

পড়তে পড়তে সত্যি দোলা লাগে মনে। যেন পৌঁছে যাই সেই সময়টায়।

 

    গানের জগতের জাদুকর তিনি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়ে অকাতরে নাড়াচাড়া করে, তার সার্থক যুগলবন্দী ঘটিয়ে পৃথিবীর যে কোনও দেশের মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে একমাত্র তিনিই তো পারতেন! অথচ সলিল চৌধুরীর মতো এক জন জিনিয়াস গীতিকার-সুরকার সেই অর্থে কোনও রাজ্য বা রাষ্ট্রীয় স্তরের সম্মান পাননি। অসম্ভব পজিটিভ ছিল তাঁর দৃষ্টি, মন, আবেগ। হেসে বলেছেন, “আমার কোনও খেদ নেই জানো। গান আমাকে বিশ্বজুড়ে ভালাবাসা পাইয়ে দিয়েছে। কত কিছুই পাইনি, শেষে সব ভুলে যাই যখন কেউ আমার গান শুনে বলে আপনি চোখে জল এনেছেন। আমি কোথাকার কে ভাই, ঈশ্বরের যিনি বরপুত্র সেই মোৎজার্ট সারা জীবনে কী পেয়েছিলেন- বঞ্চনা, বঞ্চনা আর বঞ্চনা।আজও সলিল চৌধুরীর প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি। তাঁর অসামান্য সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে যে পরিপূর্ণ শিল্পীসত্তার ছোঁয়া তিনি রেখে গেছেন, উত্তরসূরিদের জন্য যথার্থ ভাবে তার সংরক্ষণ করা দরকার।! তাঁর সব গান ছিল মানুষের জন্যে, মানবতার জন্যে। নাই বা রইল বড় মাপের কোনও পুরস্কারের তকমা। মানুষের হৃদয়ে তিনি অবিনশ্বর। মানুষের ভালোবাসায় তিনি অবিস্মরণীয়।

 (আগামী পর্বে ‘গানের একাল : গানের আকাল’)

 

 

বাংলা গানের সেকাল একাল – পর্ব ১৫

স্বর্ণযুগ নির্মাণের দুই কারিগর : শচীন দেব ও সুধাকন্ঠ হেমন্ত

 

সঙ্গীতের রাজপুত্র : শচিন  দেব বর্মন

    সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোলএ শুধু তাঁর গানের পংক্তি নয়, আশ্চর্য বৈভব মন্ডিত তাঁর সঙ্গীত জীবনের চলার ছন্দ । তিনি সঙ্গীতের রাজপুত্র - শচীন দেব বর্মণ । তিরিশ থেকে ষাটের দশক ছিল বাংলা গানের সোনার দিন, প্রাণভরে আধুনিক বাংলা গান শোনার দিনও । আর বাংলা গানের সেই সোনার দিনের নির্মাণ যাঁদের হাতে হয়েছিল তাঁদের এক অগ্রজন ছিলেন শচিন দেব বর্মণ । আধুনিক বাংলা গানের গায়কীর অনেকটাই তৈরী করে দিয়েছিলেন শচিন দেব বর্মণ । হওয়ার কথা ছিল ত্রিপুরার রাজা,হয়ে গেলেন আধুনিক বাংলা গানের মুকুটহীন রাজা । সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা বাংলা মায়ের কোলআজও যে গান তার সুরের মায়ায় আমাদের দুলিয়ে দেয় শচীন দেবের গায়কীতে এমন একটা চৌম্বক গুণ ছিল যে সেই আকর্ষণে বাঁধা পড়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না । কন্ঠ খুব ভরাট ছিল না, উচ্চারণও ছিল ঈষৎ আনুনাসিক অথচ এই নিয়েই তাঁর অনন্য গায়কী স্রোতাদের কাছে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের বিষয় হয়ে যায় । অমন  গায়নরীতি তাঁর আগে আমরা পাইনি, তার পরেও নয় ।

    শচিনদেবের জন্ম কুমিল্লাতে । শচিন দেবের পিতা  নবদ্বীপচন্দ্র তাঁর পিতা ঈশাণ চন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর সিংহাসন থেকে বঞ্চিত হয়ে চলে আসেন কুমিল্লাতে । সেখানেই জন্ম শচিনদেবের । বাল্য ও কৈশোরে দিনগুলো কাটে কুমিল্লাতেই,কলেজ শিক্ষাও । পিতা চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার পর পুত্র আগরতলায় ফিরে এসে রাজকার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন,কিন্তু শচিন আবদ্ধ হলেন সুরের মায়ায় । চেতনায় তখন ত্রিপুরার বাঁশের বাশি,ভাটিয়ালির সুর,মাঝিমাল্লাদের জীবন ও জীবিকার সুর,গোমতী নদীর অপরূপ ছন্দ,কুমিল্লার গাছ-গাছালি,নদী-নালা আর মাঝি-মাল্লাদের মাটির গন্ধমাখা সুর । জীবন সায়াহ্নে শচিনদেব আত্মকথায় বলেছিলেন কেন জানিনা জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটির টান অনুভব করে মাটির কোলেই থাকতে ভালোবাসতাম । আর বড় ভালো লাগত সেই সহজ সরল মানুষগুলোকে,গুরুজনরা যাদের বলতেন সাধারণ লোক। যাইহোক,অসাধারণের দিকে না ঝুঁকে আমি ওই সাধারণ লোকের মাঝেই নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে এক হয়ে গেলাম শৈশব থেকেই”(‘শচিন কর্তা’/পান্নালাল রায়)

    আসলে শচিন দেবের সঙ্গে কুমিল্লার সংস্পর্শ না বললে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা সম্পূর্ণ হয় না । আগরতলা তাঁকে দিয়েছিল পারিবারিক আভিজাত্য,কুমিল্লা দিয়েছিল সুর আর বাকি জীবনের চলার ছন্দ,কলকাতা দিয়েছিল শচিনদেবের প্রতিষ্ঠা আর মুম্বাই দিয়েছিল যশ ও খ্যাতির আকাশ । দেশপত্রিকায় প্রকাশিত আত্মকথায় তিনি নিজেই লিখেছিলেন খতিয়ে দেখলে আমার এ জীবনকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায় । শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনা গোমতী নদীর তীরে কুমিল্লায়,যৌবনের উন্মত্ততা ভাগীরথীর তীরে কলকাতায় যা জীবনে প্লাবন এনে দিয়েছিল এবং প্রৌঢ়ত্বের ছোঁয়া দিল আরব সাগর - এই মুম্বাইতে”রাজ পরিবারের আভিজাত্য গায়ে মেখেও শচিন দেব মাটির প্রতি মমত্ব বোধ আর মাটির গন্ধমাখা সুর আহরণ করে আধুনিক বাংলা গানের পথচলার কায়দাটাই যেন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন । শচিন দেবের প্রথম গ্রামফোন রেকর্ড প্রকাশিত হল ১৯৩২এ হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে । তাঁর কিছুটা আনুনাসিক কন্ঠস্বরের জন্য প্রথমে তখনকার মুখ্য রেকর্ড কোম্পানী এইচ এম ভি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল । হিন্দুস্থান থেকে প্রথম রেকর্ড প্রকাশের পর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি ।

    ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সন্তান হওয়ার পারিবারিক আভিজাত্য শচিন দেবের শিল্পী হয়ে ওঠা বা প্রতিষ্ঠায় অনুঘটকের কাজ করেনি বিন্দুমাত্র,বরং কিছুটা অভিমানই ছিল রাজ পরিবারের প্রতি । ১৯৪৪এ স্থায়ীভাবে মুম্বাই চলে যাবার পর ত্রিপুরার প্রতি ভালোবাসার টান থাকলেও রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হতে থাকে । ১৯৪৬এর পর শচিনদেব আর আগরতলায় যাননি । কোন রাজপরিবারের আভিজাত্যের ছাপ না থাকা মীরা দাশগুপ্তাকে বিবাহ আগরতলায় তাঁর পরিজনরা মেনে নেয় নি । তাঁর অভিমান ও রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণ হয়তো এটাই ।

       এক আশ্চর্য সাঙ্গীতিক আভিজাত্যের মোড়ক তাঁকে মর্যাদা মন্ডিত করেছিল  কৃষ্ণ চন্দ্র দের কাছে গান শিখেছিলেন,উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে । হিন্দি সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনায় গগনচুম্বি খ্যাতি পেয়েছিলেন,কিন্তু নিজেকে এক মর্যাদামন্ডিত ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালিছাড়া আর কিছুই ভাবতে দেননি কাউকে, কলকাতার শহুরে বাংলাভাষাও রপ্ত করার কোন চেষ্টা করেন নি,ভোলেননি কুমিল্লার ভাষাভঙ্গি । সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোলএ শুধু তাঁর গানের পংক্তি নয়,আশ্চর্য বৈভব মন্ডিত শচিনদেবের সঙ্গীত জীবনের চলার ছন্দ । আবার এপার বাংলার প্রতি অনেক অভিমানও ছিল শচিন দেবের । বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক নারায়ন চৌধুরীকে বলেছিলেন “... আজ যদি কেউ আমাকে কলকাতা থেকে প্রস্তাব করে পাঠাত, তোমাকে পাঁচশো টাকা করে মাসোয়ারা দেব,তুমি আবার আমাদের মধ্যে ফিরে এসো,আমি তন্মুহুর্তে মুম্বাই-এর তল্পিতল্পা গুটিয়ে কলকাতা চলে আসতুম আবার সেই পুরনো দিনের মত গানে গানে মেতে উঠতুমজীবন সায়াহ্নে নিজের উপলব্ধি লিখে গেছেন তিনি নিজের শুধু এই পরিচয় যে আমি বাংলা মায়ের সন্তান এবং আমার সুরসৃষ্টি সমগ্র ভারতবাসীর সম্পদ আমার সুর ভারতবর্ষের প্রতীক”(সূত্রঃশচিন কর্তা’/পান্নালাল রায়)

    শচিনদেব প্রথম গানের রেকর্ড করেন ১৯৩২এ আর শেষ গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৬৯এ । এই দীর্ঘ ৩৭ বছরে শচিনদেব রেকর্ডে বাংলা গান গেয়েছেন মাত্র ১৩১টি । ১২৭টি একক এবং ৪টি দ্বৈত কন্ঠে স্ত্রী মীরার সঙ্গে । এর একটা কারণ শচিনদেব অন্যের সুরে গান প্রায় গাইতেনই না,এবং নিজের পছন্দ মত গীতিকার ছাড়া অন্যের গীত রচনাতেও গান গাইতেন না । বাংলা গানের জগতে শচিনদেবের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিক বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ঘটনায় আরো দুজন মানুষের কথা একই সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন তারা হলেন শচিনদেবের কুমিল্লার সাথী সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য । তাঁর গাওয়া ১৪১টি বাংলা গানের মধ্যে সুরসাগর হিমাংশু দত্তর সুরে ৮টি,কাজী নজরুলের সুরে ৬টি ছাড়া সব গানই গেয়েছিলেন নিজের সুরে । শচিনদেবের বেশিরভাগ লোকপ্রিয় গানের গীত রচনা করেছিলেন অজয় ভট্টাচার্য । আধুনিক বাংলা গানের গায়ন শৈলীতেই এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন । শুধুমাত্রে ঈষৎ আনুনাসিক ও দরাজ কন্ঠস্বরের জন্যই নয়,বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় আত্মীয়তার ফলে বাংলার লোক সুর আর মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে মিশে তাদের সুর তুলে এনেছিলেন আর আশ্চর্য দক্ষতায় শাস্ত্রীয় সুরের সঙ্গে মাটির সুরের মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা গানকে দান করেছিলেন অপার ঐশ্বর্য । শচিন দেব তাঁর জীবন কথায় লিখে গেছেন ১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত এই ৫/৬ বছরে লোকসঙ্গীত ও ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের সংমিশ্রনে নিজস্ব ধরণের সুর রচনা করলাম যা অন্য কারো সঙ্গে মিললো না । এইভাবে আমি আমার নিজস্ব গায়কী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম”(সূত্র- শচিনকর্তা’/পান্নালাল রায়) এই পর্বে আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে’(১৯৩৬), কিংবা প্রেমের সমাধি তীরে’ (১৯৪০)র মত রাগাশ্রয়ী আধুনিক গান কিংবা লোক সুরের মিশ্রণে সেই যে বাঁশি বাজাবার দিনগুলি’(১৯৫১),‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে’(১৯৫১), কিংবা ষাটের দশকের শেষ দিকে রেকর্ড করা মন দিল না বধু’,‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলাএখনো গানপ্রিয় বাঙালির হৃদয়ে দোলা দেয় । অথচ আমাদের অপার বিস্ময় বাংলা ছায়াছবি শচিন দেবের সুরের ঐশ্বর্য প্রায় বর্জনই করেছিল । ১৯৩২এ বাংলা ছায়াছবি সবাক হওয়ার পর ১৯৩৮এর মধ্যে মাত্র ৫/৬টি বাণিজ্যিক ভাবে অসফল বাংলা ছায়াছবিতে তিনি গান গেয়েছিলেন ।

    এ কথাও মনে করা যেতে পারে যে শচিনদেবের সাঙ্গীতিক রুচি ও আভিজাত্য সেকালের ছায়াছবির জগতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি । তিনি অন্যের সুরে গান করতেন না । সঙ্গীত পরিচালক অন্য কেউ হলেও তাঁর গীত গানের সুর তিনি নিজেই করতেন । শুধুমাত্র একটি ছায়াছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে একটি গান করতে সম্মত হয়েছিলেন । আর একটি সর্ত থাকত,তাঁর গাওয়া গান ছবির কোন চরিত্রের কন্ঠে থাকবে না,শুধুমাত্র নেপথ্য দৃশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে গীত হবে । কিন্তু ক্ষতি যে বাংলা চলচ্চিত্রের হয়েছিল তাতে সংশয় নেই । বাংলা ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসাবেও শচিনদেব কোন সুযোগ পাননি । ১৯৩২এ বাংলা ছায়াছবি সবাক হওয়ার পর দুটি অসফল ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন,তারপর কোন প্রযোজক,পরিচালক তাঁকে ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ দেন নি । কোন ডাক না পেয়ে কিছুটা অভিমান নিয়েই বাংলা ছেড়ে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন । ১৯৪২এ মুম্বই যাওয়ার প্রথম ডাক পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । চেয়েছিলেন বাংলাতেই থাকার । কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র জগত থেকে কোন ডাক না পেয়ে অভিমানাহত হয়ে ১৯৪৪এ মুম্বাই চলে গেলেন পাকাপাকি ভাবে । দেশপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর আত্মকথনে (মার্চ ১৯৬৯ শচিনদেব লিখেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করার আকাঙ্খা ছিল খুব । কিন্তু কোন সুযোগই পাচ্ছিলাম না ......কোথাও কোন চলচ্চিত্র সংস্থা আমাকে সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ না দেওয়াতে মনে খুবই দুঃখ হয়েছিলতাই ১৯৪৪এ দ্বিতীয় বার যখন মুম্বাই থেকে ডাক পেলেন,আর ফিরিয়ে দিলেন না ।

    তারপর হিন্দি সিনেমার গান তাঁর সুরের জাদুতে কি অসামান্য উচ্চতা স্পর্শ করেছিল তা তো ইতিহাস হয়ে আছে । মুম্বাই সিনেমার গান ঐশ্বর্যময়ী হয়ে উঠলো বাংলার মাটির সুরের স্পর্শে আর বাংলা ছায়াছবি কোন শচিন দেবের ছোঁয়া পেল না । কিন্তু যেটুকু পেয়েছে বাংলা সঙ্গীত জগত তাই বা কম কি ? শচিনদেব চলে গেছেন আজ প্রায় চার দশক হল(মৃত্যু- ৩১ অক্টবর ১৯৭৫)বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারে যে ১৩১টা গান রেখে গেছেন শচিনদেব,আজও সব প্রজন্মের মানুষ অবাক বিস্ময়ে শোনেন,দোলায়িত হন তাঁর সুরের মায়ায় ।

 

সুধাকন্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : আধুনিক, চলচ্চিত্র ও রবীন্দ্রগানে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়

    বাঙালির প্রিয় যে কয়েকটি নাম গত আশি বছর ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে, তাঁদের একজন তিনি ধুতি-শার্ট পরা দীর্ঘদেহী সৌম্যকান্তি মানুষটি যে আবির্ভাবেই হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন এমন নয়, উত্থান ঘটেছিল তাঁর ধীরে , কিন্তু অবিসংবাদীভাবে, তারপর খ্যাতি পৌছেছিল কিংবদন্তী স্তরে । শুধুই কি কিংবদন্তী সুধাকন্ঠ শিল্পী ? না । তিনি ছিলেন এক প্রতিষ্ঠান – এক এবং অনন্য । চেহারায়, চরিত্রে, পোষাকে, ব্যবহারে, রুচিতে, হৃদয়বত্তায় আভিজাত বাঙালির এক বিরল নিদর্শন ছিলেন তিনি । তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়২০১৯এ শতবর্ষ ছুঁলেন বাংলার অনন্য সঙ্গীত প্রতিভা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

 

    বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর ইঞ্জিনীয়ার হোক,শুরুও করেছিলেন ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া যাদবপুর কলেজে । কিন্তু ছেড়ে দিলেন । তাঁর সুধাকন্ঠে গান বাসা বেঁধেছে যে ! প্রাণের বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিয়ে গেলেন রেডিওতে গান গাইবার অডিশন দিতে । তিনি তখন মিত্র ইনষ্টিটিউশনে সবে ক্লাস টেনএ উঠেছেন । রেকর্ড কোম্পানীর দুয়ারে বন্ধুকে নিয়ে ঘুরলেন সুভাষ, গ্রামফোন রেকর্ডের গান করার জন্য । কলকাতায় যখন বেতার ব্যবস্থা চালু হল হেমন্ত তখন সাত বছরের বালক । আট বছর পরে সেই হেমন্ত ১৯৩৫এ পনেরো বছর বয়সে রেডিওতে গান করলেন । গানের সঙ্গে অল্প-স্বল্প সাহিত্য চর্চা । দেশপত্রিকাতে ছাপা হল তাঁর লেখা গল্প একটি দিন১৯৩৭এ প্রথম তাঁর দুটি গানের রেকর্ড বেরলো, প্রাপ্তি হল কুড়ি টাকা । কমাস পরে আরো একটি রেকর্ড করার সুবাদে আরো কুড়ি টাকা । চল্লিশ টাকা হল । এবার বাবা ছেলের জন্য একটা হারমোনিয়াম কিনে দিলেন ।

 

     সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় বিধি অনুযায়ী কোন তালিম নেননি । বাসনা ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেওয়ার, কিন্তু তাহলে আধুনিক গান গাওয়া চলবে না এমনই পূর্ব-সর্ত ছিল । অতয়েব শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেওয়া হল না । তাঁর প্রথম সংগীতশিক্ষক শৈলেশ দত্তগুপ্ত হেমন্তকে বলেছিলেন তুই তো কেবল আধুনিক গান করছিস, রবীন্দ্রসংগীতটাও শুরু কর । অফুরন্ত ভান্ডার, গেয়ে কুলকিনারা করতে পারবি নাহেমন্ত শান্তিনেকেতনে সঙ্গীত শিক্ষা করেন নি । অথচ কি মন্তর হেমন্তর’ ! তাঁর সময়ে তিনিই ছিলেন রবীন্দ্রগানের শ্রেষ্ঠ প্রচারক । গানের জলসায় আসর শুরু করতেন রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে । এ ব্যাপারে তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক  গ্রামফোন রেকর্ডে, গানের জলসায়, রেডিও, চলচ্চিত্রে, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্যে, কন্ঠের জাদুস্পর্শে রবীন্দ্রগানকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর তন্ময় প্রয়াস বাঙালিকে মনে রাখতেই হবে । সিনেমায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রয়োগে তিনি অগ্রপথিক ছিলেন না, কিন্তু তার অবদান সবচেয়ে ব্যাপক আমাদের সঙ্গীত রুচির নির্মাণে হেমন্তর আজীবন নিষ্ঠা অবিস্মরণীয় । আত্মকথন ‘আনন্দধারা’য় হেমন্ত লিখে গেছেন “এটা আমার প্রাণের জিনিস ...এই রবীন্দ্র সঙ্গীতের দিকে তাকিয়ে আমি বেঁচে আছি । আমি তো জানি,সব চলে যাবে,  একে একে বিদায় নেবে আমার গলা থেকে, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না” এই আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিবেদনই তাঁকে দিয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের এক পৃথক অভিজাত আসন । শান্তিনিকেতনে দীক্ষিত না হয়েও রবীন্দ্রনাথের গানে হেমন্তর কন্ঠ এখনও অপ্রতিদ্বন্দী, মৃত্যুর বত্রিশ বছর পরেও ।  রবীন্দ্রগানই ছিল তাঁর ‘শেষ পারানির কড়ি’

 

    ১৯৫১র মার্চে মুম্বাই পাড়ি দিলেন ফিল্মিস্তানের মালিক প্রযোজক শশধর মুখার্জীর আহ্বানে, দেড়হাজার টাকার বেতনে । এর মধ্যেই সংগীত পরিচালনা, গান গাওয়া সব । তিনি তখন হেমন্ত কুমার । এই সময়ে শচীন দেব বর্মন তাঁকে ডেকে নিলেন ‘জাল’ ছবিতে । ‘জাল’ ও ‘আনারকলি’ ছবির সাফল্য প্লেব্যাক শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিল হেমন্তকুমারকে । তারপর এল ফিল্মিস্তানের ‘নাগিন’ ‘নাগিন’ এর সঙ্গীত নির্মাণ ও তার প্লেব্যাক মুম্বাই সিনেমাজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করল, হেমন্ত পেলেন অভূতপূর্ব খ্যাতি । একই সময়ে ১৯৫৪তে কলকাতায় পরিচালক সুধীর মুখার্জী ডাকলেন তাঁর ‘শাপমোচন’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার জন্য‘শাপমোচন’ ছায়াছবির সুরকার ও গায়ক হিসাবে হেমন্তকে দিল চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা । তাঁর আত্মকথন ‘আনন্দ ধারা’য় লিখেছেন - 

    “‘নাগিন’ আর ‘শাপমোচন], দুদিকে দুটো ডানা তখন আমায় উড়িয়ে নিয়ে চলেছে । উনিশশো চুয়ান্ন, পঞ্চান্ন, ছাপ্পান্ন – এই দিনগুলো যেন সোনার প্রজাপতি । ডানা নাড়ছে আর ঝরখর করে সোনা ঝরছে

 

    বাংলায় শাপমোচনএর পর হেমন্তকে আর পেছন ফিতে তাকাতে হয়নি । একের পর এক ছায়াছবিতে সুর করেছেন, গান গেয়েছেন । ‘হারানো সুর’, ‘শেষ পর্যন্ত’, ‘সূর্যমুখী’, ‘মণিহার’,’মন নিয়ে’, ‘দুই ভাই’, ‘পলাতক’, ‘কুহক’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘অজানা শপথ’, ‘অদ্বিতীয়া’,  ‘বাদশা’,’বালিকা বধু’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘আলোর পিপাসা ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ এমন কত ছায়াছবির গান আমরা এখনো বারবার শুনতে চাই ।  অন্যের সঙ্গীত পরিচালিত ছায়াছবিতে অসংখ্য গান নবীন প্রজন্মের তরুণদেরও আনমনা করে দেয় । বেসিক ডিস্ক এবং ছায়াছবিতে কত গান গেয়েছিলেন তার সংখ্যা তিনি নিজেও বলতে পারতেন না । সঙ্গীত গবেষকরা বলেন তিনি প্রায় পাঁচ হাজারের মত গান করেছেন তাঁর চুয়ান্ন বছরের সঙ্গীত সফরে সুর ও  গায়কীতে আধুনিক বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়েছিলেন শচিন দেব বর্মন চল্লিশের দশকে, আর পঞ্চাশ থেকে সত্তর সময়কালে আধুনিক বাংলা গানে যুগ নির্মাণের প্রধান কারিগর ছিলেন এই মানুষটি – সুধাকন্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ।

 

    হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত জীবনে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সংস্পর্শ অবশ্যই এক উল্লেখযোগ্য বিষয় । এই সূত্রেই হেমন্তর কন্ঠ আর সলিল চৌধুরীর সুরের যুগলবন্দী বাংলা কাব্যসঙ্গীতে সঞ্চিত করে রেখেছে অনুপম ঐশ্বর্য় । ‘গাঁয়ের বধু’, ‘রানার’ ‘পাল্কির গান’ ‘ঠিকানা’, ‘অবাক পৃথিবী’ ‘নৌকা বাওয়ার গান’ ‘ধান কাটার গান’ গ্রামফোন রেকর্ডের এই সব গানগুলি প্রকৃত অর্থেই লিজেন্ড হয়ে গেছে । বাঙ্গালি বোধয় আগামী একশো বছরেও এ গান শোনা থেকে বিরত থাকবে না ।

    সারাজীবন পরিধান ধুতি আর সাদা সার্ট ,অত্যন্ত সাদাসিধে রুচিশীল চালচলনে, জীবনযাপনে ষোল আনা বাঙ্গালিয়ানাগানের সঙ্গে যন্ত্র বলতে হারমোনিয়াম, তবলা আর খোল । স্পষ্ট উচ্চারণে গান গাইতেন অনেকের মত মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে ভাবভঙ্গী করে নয় । নিজের লেখা আত্মকথা আনন্দধারাতে লিখেছেন একটা রোগা লম্বা ছেলে একদিন কোন কিছু সম্বল না করে গানের দিকে ঝুঁকেছিল । ভবিষ্যতের কথা সেদিন ভাবে নি একটুও । অভাবের সংসারে মানুষ হয়ে এত বড় ঝুঁকি কী করে নিতে পেরেছিল সেদিন সেই জানে । ভরাডুবি হলে আর বাঁচবার রাস্তা নেই । শেষ পর্যন্ত তা হল না । জিতে গেল সেই ছেলেটি

    দেশে, বিদেশে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন হেমন্ত । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আলাউদ্দিন পুরস্কার, রবীন্দ্রভারতী ও কলকাতা বিশ্বিবিদ্যালয়ের সান্মানিক ডক্টরেট, বাংলাদেশ সরকারের মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার ইত্যাদি । সঙ্গত অভিমানে প্রত্যাখ্যান করেছেন পদ্মশ্রী সম্মাননা । দুবার প্রস্তাব এসেছিল পদ্মশ্রী সম্মাননা গ্রহণের । হেমন্ত বলেছিলেন আমার কনিষ্ঠ, আমার সহকারীরা ঐ সম্মাননা পেয়ে গেছেন অনেক আগে, যদি পরেরটা (র্থাৎ পদ্মভূষণ) দিতে পারো দাও ।

 

    অনন্যকন্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চলে গেছেন আজ বত্রিশ বছর হল । এখন এই প্রজন্মের বাঙালির জীবনধারায়,তার সাংগীতিক রুচির অনেক বদল ঘটে গিয়েছে সত্য । তবুও মৃত্যুর বত্রিশ বছর পরেও ৬৫/৭০বছর আগে গাওয়া গাঁয়ের বধু’, ‘পালকির গান’, ‘রাণারকিংবা শাপমোচন, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘পলাতক’, ‘কুহক’, ‘শেষ পর্যন্ত’, ইন্দ্রাণী - এইসব অজস্র ছায়াছবির গান এখনও যে মাদকতা ছড়ায় তা অগ্রাহ্য করবে কোন সংগীতপ্রিয় বাঙালি ? মধ্যবিত্ত বাঙালির রোমান্টিকতা আর পরিশীলিত রুচিবোধের সঙ্গে মিশে আছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ।

    সুদীর্ঘ জীবন হেমন্তর ছিল না। ১৯৮৩তে হৃদযন্ত্রের ও কন্ঠের সমস্যা দেখা দেয়, শরীর ভাঙতে থাকে । রেকর্ড করা বন্ধ করে দেন । শুধু গানের জলসায় গাইতেন । অজস্র সম্মাননা পেয়েছেন, গান নিয়ে বিদেশ সফর করেছেন অনেক । বলতেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গান গেয়ে যাবোএ কথা যেন আক্ষরিক অর্থেই সত্যি হয়েছিল । ১৯৮৯এর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরে যান, গ্রহণ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্মাননাঢাকার অনুষ্ঠানে শুনিয়ে ছিলেন জাদুকন্ঠের সেই গান আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরেঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরে আসার কয়েকদিন পর ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৮৯,হেমন্তর সুধাকন্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায় চিরতরে, মাত্র ৬৯বছর বয়সে চলে যান এই অনন্য সংগীত প্রতিভা ।

    আমরা জানি না আধুনিক বাংলা গানে এমন মাদকতাপূর্ণ গায়কী, রবীন্দ্রগানের এমন তন্ময় নিবেদন আর কারো কাছে কোন দিন পাবো কি না । জানি না আর একজন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়বাঙালি কোনদিন পাবে কি না । কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকবেন তাঁর মায়াময় কন্ঠের গান নিয়ে যতদিন

বাঙালির গান শোনার কান থাকবে ।

পরের পর্বে ‘অন্য ধারার গান’ : গণ সঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী
  

 

 

 

 

 

 

 

বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ১৬

  অন্য ধারার গান : গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী     গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীতধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কা...