বিপন্ন শৈশব : ফিরে চলো শিকড়ের কাছে
সারা বিশ্ব জুড়েই শিশুমেধ যজ্ঞের
অবাধ আয়োজন । বাহাত্তর বছর আগে জাপানের হিরোসিমা-নাগাসাকিতে আনবিক বিস্ফোরণ লক্ষ
লক্ষ শিশু নিধন করেছিল । যুদ্ধোত্তর বিশ্বে প্রতিদিন যুদ্ধে আর দারিদ্র, অপুষ্টিতে
লক্ষলক্ষ শিশু মারা যাচ্ছে । জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে তৃতীয়
বিশ্বে প্রতি দিন চল্লিশ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে অপুষ্টি, অনাহারে । সেসব কথা নাহয় থাক । আমি বলি বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের কথা যেখানে আমরা বলি ‘আমার
সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ । সেইসব শিশুরা আর এক রকম হানাদারির শিকার, যে হানাদারিতে লোপাট হয়ে যাচ্ছে শৈশব । আমি লোপাট হওয়া শৈশবের কথাই বলি
।
শিরোনাম ‘বিপন্ন
শৈশব’ । বিপন্নতা নয়, বলা ভালো শৈশবের লোপাট হয়ে যাওয়া । আমাদের
সামাজিক জীবনে কৈশোর থেকে বার্ধক্য – প্রতিটি পর্যায়ের নিশ্চিত কিছু লক্ষণ থাকে ।
শৈশবের লক্ষণগুলি বরং বেশি স্পষ্ট। সেই লক্ষণগুলিই যদি অদৃশ্য হয়ে যায় আজকের
প্রজন্মের শিশুদের জীবন থেকে, তবে আর শুধু বিপন্নতা বলবো কেন ? কেন না এই বিপন্নতা
থেকে উদ্ধার পাওয়ার আপাতত কোন সংকেত তো পাওয়া যাচ্ছে না । এবং এটা এমন একটা বিষয়
যে আমরা হাহাকার করি বটে তবুও সেই বিপন্নতাকে আমরা মেনে নিচ্ছি, মেনে নিতে বাধ্য
হচ্ছি ।
শৈশবের এই বিপন্নতার শুরু তো আজকের
নয় । গত শতকের আশির দশক থেকেই তো এই বিপন্নতার সূত্রপাত । বিশ্বায়ন নামক পাঁচ
অক্ষরে এক দানব যখন আমাদের ভাষা, কৃষ্টি, মূল্যবোধ এবং বহুযুগ ধরে লালিত আমাদের
সমাজ বন্দোবস্ত নিয়ে আমাদের আবেগকে এলোমেলো করে দিতে শুরু করলো । বিশ্বায়ন দিল
অনেক কিছু, বিনিময়ে গিলে ফেলতে লাগলো আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস আর সামাজিক
বাঁধন । শিশুরাই তো সহজ শিকার । আমরাও সন্তানের দুবছর পূর্ণ হওয়া মাত্র তার শৈশব
কেড়ে নিয়ে তার পিঠে বইয়ের ব্যাগ সেঁটে দিয়ে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে সামিল করে দিচ্ছি, তার
শৈশবকে হত্যা করছি । শৈশব নেই, তাই শিশু যেন বড় হয়ে যাচ্ছে আর তার পিতা-মাতা
খুশিতে ডগমগ ‘দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি’ । অতি সম্প্রতি, আমরা সকলেই সংবাদপত্র প্রতিবেদনে দেখেছি ৬ষ্ঠ
শ্রেণীর এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে বয়ান লিখে রেখে ‘ওপর থেকে দিদির বিয়ে দেখবো’ । এ কি ১১ বছরের
কিশোরীর কথা ? যে পারিবারিক বন্ধন, পিতা-মাতা পরিজনদের অন্তরঙ্গতা, ভালোবাসা আর
প্রকৃতির অসীম অন্তরঙ্গতা তার শৈশবকে, শিশুমানসকে গড়ে তোলে তা থেকেই সে বঞ্চিত
হচ্ছে । আত্ম নিধন করে বুঝিবা কিশোরীটি জানিয়ে দিল সে ভীষণ একা ছিল, ভালোবাসাহীন
ছিল ।
শুধুই কি একাকিত্ব ? পিতা-মাতার স্নেহচ্ছায়াও কি
আজকের শিশুদের শৈশবকে ঘিরে রাখছে যথার্থ অর্থে ? চাপিয়ে দেওয়া শৃঙ্খলার বেড়ি পড়ে
সে কোন প্রশ্ন করে না, সমাজ সম্পর্কে তার কোন কৌতুহল নেই, নেই কোন কল্পনার জগৎ ।
তার মনোজগৎকে গড়ে তুলতে তার পিতা-মাতার দায় বড় কম নয় । শৈশবকে মাতৃস্নেহের ছায়া
ঘিরে থাকলে একজন এগারো বছরের বালক মাত্র ২৫০ টাকার জন্য তার বন্ধুকে হত্যা করতে
পারে না ।
একজন শিশুর
যে বয়সে পিতা-মাতার, মাসি-পিসির কোলে বসে ছড়া, গল্প শুনে বিস্ময়ে মুগ্ধ হবার সময়, কল্পনার
জগতে ভাসবার সময়, তখন তার পিঠে উঠছে বইয়ের ব্যাগ, হাতে জলের বোতল । শৈশবে যখন তার
প্রকৃতির জগত থেকে জ্ঞান সঞ্চয় করার কথা, নাগরিক জীবনে সে তখন টেলিভিশনের ডিজনি চ্যানেলে
বন্দী । সে ফড়িং, প্রজাপতি
দেখেনি, চড়াই, শালিক দেখেনি । তার খেলার সাথী নেই, খেলার মাঠ নেই, মাসি পিসি নেই,
‘শোলোক বলা কাজলা দিদি’রা নেই। আজকের শিশুরা বড় একা । অবসাদের বীষ কি করে জীর্ণ করছে
তার শৈশব সে খবর রাখি না । এবং আমরাই আজকের শিশুর পিতা-মাতারাই তাকে একাকিত্ব দিয়েছি,
দিয়ে চলেছি । বিশ্বায়ন পরবর্তী প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্ম এখন শিশুর পিতা-মাতা ।
তাদের সঙ্গে বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ভাষার অনাত্মীয়তা আজকের প্রজন্মের শিশুদের
প্রভাবিত করেছে তাতে সংশয় নেই । তারাও তো সেইসব ছড়া, গল্প রূপকথা শোনেনি, তারাও তো
একাকিত্ব নিয়েই বড় হয়েছে !
একশো
বছরেরও বেশি আগে কোন তাগিদ থেকে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ লিখেছিলেন
? কিংবা বাংলা শিশু সাহিত্যের পিতৃপুরুষ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী লিখেছিলেন
টুনটুনির গল্প, ছেলেদের রামায়ণ ? প্রজন্মের পর প্রজন্ম শিশুমানসের নির্মাণ করেছে
বাংলার চিরায়ত শিশুসাহিত্য সম্ভার । এইসব গল্প, রূপকথা শোনানোর মধ্য দিয়েই শৈশবকে
ঘিরে রাখতো মায়ের স্নেহচ্ছায়া । ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ...
“...ইহার
উৎস বাংলা দেশের মাতৃস্নেহের মধ্যে । যে স্নেহ দেশের রাজ্যেশ্বর রাজা হইতে দীনতম
কৃষককে পর্যন্ত বুকে করিয়া মানুষ করিয়াছে,
সকলকেই শুক্ল সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ দেখাইয়া
ভুলাইয়াছে এবং ঘুমপাড়ানি গানে শান্ত করিয়াছে। নিখিল বঙ্গের সেই চির পুরাতন গভীরতম
স্নেহ হইতে এই রূপকথা উৎসারিত । অতয়েব বাঙালির ছেলে যখন রূপকথা শোনে – তখন কেবল যে গল্প
শুনিয়া সুখী হয়, তাহা নহে – সমস্ত বাংলা দেশের চিরন্তন স্নেহের সুরটি তাহার তরুণ চিত্তের মধ্যে প্রবেশ
করিয়া তাহাকে যেন বাংলার রসে রসাইয়া তোলে”। রবীন্দ্রনাথের এই নির্দেশ থেকেই আমি বুঝতে চেয়েছি, তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাতৃস্নেহের চিরন্তন সুরটি কেমন
করে আলগা হয়ে গেছে ।
সর্ব দেশেই দেশজ কৃষ্টি-সংস্কৃতির বাঁধনে
শিশুমানস গড়ে ওঠে তার মৌখিক সাহিত্য – ছড়া, গল্প, রূপকথা শোনার মধ্য দিয়ে । ভাষাচার্য সুকুমার সেন যুগ যুগান্তের
ধারাবিকতায় প্রবহমান ছড়া – গান- রূপকথার গল্প কে চিহ্নিত করেছেন ‘শিশু-বেদ’ বলে । মুণি ঋষিদের
মুখে মুখে সৃষ্ট চার খন্ডের বেদ যেমন কোন এক মানব গোষ্ঠীকে আদি-অনন্ত কাল থেকে
নিয়ন্ত্রিত করছে,সে ধ্রুব সত্য বলে মেনেছে ,
তেমনই রচয়িতার নাম না জানা অথচ সময়ের আদীমতম
কালখন্ড থেকে মানুষের মুখে মুখে সৃষ্ট প্রবহমান শিশুতোষ ছড়া-গান-গল্প তো আরো এক
বেদ – শিশু-বেদ । সমস্ত মানব গোষ্ঠিরই এই ‘শিশুবেদ’
আছে,
এমনকি যে মানব-গোষ্ঠীর কোন স্থায়ী সাহিত্য
নেই তাদেরও । সর্বদেশে সর্বকালে এই ছেলেমি ছড়া শুনে শুনেই আমরা বড় হয়েছি, জীবনকে জেনেছি, চিনেছি, আমাদের সাহিত্যেরও
বীজ হয়ে গেছে এইসব অজস্র লৌকিক ছড়া, রূপকথার গল্প,গান । আর তাইতো শিশু সাহিত্যের চিরকালীন
উপাদান লোক পরম্পরায় প্রচলিত ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’র আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “ভালো করিয়া দেখিতে
গেলে শিশুর মত পুরাতন আর কিছুই নাই । দেশ কাল শিক্ষা প্রথা অনুসারে বয়স্ক মানবের
কত নতুন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শত সহস্র বৎসর পূর্বে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে; সেই অপরবর্তনীয়
পুরাতন বারম্বার মানবের ঘরে শিশুমূর্তি ধরিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে – অথচ সর্বপ্রথম দিন
সে যেমন নবীন, যেমন সুকুমার, যেমন মূঢ় যেমন মধুর ছিল আজও ঠিক তেমনই আছে । এই নবীন চিরত্বের
কারণ এই যে শিশু প্রকৃতির সৃজন” ।
টেলিভিশন, ইনটারনেটের নাগরিক
জীবনের মধ্যে থেকেও বাংলার ছড়া, রূপকথার গল্পগুলির সঙ্গে যদি তাদের পরিচিতি ঘটাই তাহলে কমিকসের
সর্বনাশা নেশায় তারা হয়তো আটকে থাকতে পারতো না । আমরা শিশুদের মনে সেই আগ্রহ
সঞ্চার করতে পারছি না । অথচ এইসব ছেলেমি ছড়া রূপকথার মধ্যে শিশুমনের তাৎক্ষণিক
স্বপ্নবিলাস ও জীবনের নানান অভিজ্ঞতার পথনির্দেশ রয়েছে । বদলে তাদের শোনানো হচ্ছে
আমেরিকার স্কুলে বন্দুকবাজদের হামলার কাহিনী, তাকে সামিল করে দিচ্ছি টেলিভীশনের অবাস্তব রিয়ালিটি শো আর আমরা বিপন্ন শৈশব
বলে হাহাকার করছি ।
মনোবিদরা আলোচনা করছেন, বিপন্নতার
কারণ নির্দেশ করছেন । কিন্তু যাদের জন্য করছেন তারা কতটা সচেতন হচ্ছেন তাতে সংশয়
থাকছে । একটা প্রবণতা বোধকরি কারোরই চোখ এড়ায় না যে বহুজাতিক কোম্পানীগুলির
বিজ্ঞাপনের টার্গেট শিশুরা । তারাই কোন কোম্পানীর কি জিনিস কিনবো ইত্যাদি ঠিক করে
দিচ্ছে । বাংলা টেলিসিরিয়ালগুলোতে শিশুদের অভিনয় করানো হচ্ছে হিংশা, বিদ্বেষ
ছড়ানো ষড়যন্ত্রকারী চরিত্রে। শিশু তার পিতা-মাতার সঙ্গে সেইসব সিরিয়াল গিলছে, তার
সুকুমার প্রবৃত্তিগুলি ধ্বংস হচ্ছে, আর সমাজ নির্বিকার । এই সমাজের এক পিতা
সামান্য টেনিস প্রশিক্ষণে তার বালক পুত্রের অমনোযোগের জন্য নিজ সন্তানকে পিটিয়ে
মেরে ফেললেন । শৈশবের নিরাপত্তাহীন এ কোন বিকারগ্রস্ত সমাজ ? আমরা বিপন্ন শৈশব বলে
হাহাকার করছি কিন্তু নতুনতর জীবনবোধের স্বপ্ন দেখছিনা, সন্তানদের মধ্যে তেমন
জীবনবোধের সঞ্চার করছিও না । তাকেও শেখাচ্ছি শুধু নিজের জন্য বাঁচা আর আজকের জন্য
বাঁচার কথা । রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে
অধ্যাপক ও নন্দিনীর কথোপকথন মনে পড়ে । অধ্যাপক নন্দিনীকে বলছেন ‘আমরা যে মরা ধনের
শবসাধনা করি । তার প্রেতকে বশ করতে চাই । সোনার তালের তাল-বেতালকে বাঁধতে পারলে
পৃথিবীকে পাবো হাতের মুঠোর মধ্যে’ । এখন তো বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখি ‘হাতের
মুঠোয় পৃথিবী’ । আমার সন্তান তার শৈশব কাটাচ্ছে ‘বাজারবন্দী’ সমবেদনাহীন
বদলে যাওয়া এই সমাজে ।
তবু বিশ্বাসের একটা ভিত্তিভূমি
থাকে । সেই বিশ্বাসের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে বলি শৈশবের বিপন্নতা থেকে পরিত্রাণ
পেতে হবে । পাবো, যদি আবার শিকড়ের কাছে ফিরে যাই । জীবনবোধ সংপৃক্ত শিশুসাহিত্য
যদি আমার সন্তানের শৈশবকে ঘিরে রাখে । আমি সেই বিশ্বাস রাখতে চাই ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন