বাংলা গানের সেকাল একাল – ৬
গ্রামফোনের যুগ – বাংলা গান হল বিপণন সামগ্রী
কীর্তন, লোকগান,
রামপ্রসাদী, কবিগান, পাঁচালী গান থেকে থিয়েটারের গান - – বিভিন্ন ধারার বাংলা গান বাঙালির একান্ত
প্রাণের জিনিস হয়ে উঠেছিল । গানের এমন বৈচিত্রপূর্ণ সমাবেশ অন্যকোন ভাষাভাষীদের
মধ্যে ছিল না, আজও নেই । সুতরাং বাংলা গানের বিপননযোগ্য পণ্যমূল্য তৈরি হল আর তা
বুঝতে ইংরাজ বনিকদের দেরি হল না । ১৮৭৭এ টমাস আলভা এডিসনের বিস্ময়কর উদ্ভাবন ফোনোগ্রাফ যন্ত্র
। কন্ঠস্বর ধ্বনিবদ্ধ করে আবার শোনার বন্দোবস্ত । তেরো বছর পরে ১৮৯০এ বিজ্ঞানী
এমিল বার্লিনার কন্ঠস্বর ধ্বনীবদ্ধ করা ও শোনার পদ্ধতির আরো উন্নতি ঘটিয়ে উদ্ভাবন
করলেন গ্রামফোন বা কলের গান । বিশ শতকের গোড়াতেই কলকাতা চলে এল ‘কলের গান’ । ১৯০১এর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতাবাসি
একটা বিজ্ঞাপন দেখলো, বিজ্ঞাপনদাতা – ১৪৭ ধর্মতলা স্ট্রীটের ঠিকানার ‘এডিসনস
ফোনোগ্রাফ এজেন্সি’। দাম
পঞ্চাশ টাকা । কলের গান তো এলো কিন্তু
গাইবে কে ? মেয়েদের গান গাওয়া তখনকার সমাজ অনুমোদন করতো না। এমনকি পুরুষদেরও
অর্থের বিনিময়ে গান গাওয়া সমাজ অনুমোদিত ছিল না । রেকর্ড কোম্পানি স্মরণাপন্ন হলেন
প্রখ্যাত নট নাট্যকার পরিচালক অমরেন্দ্রনাথ দত্তর । অমরেন্দ্রনাথের সহায়তায় ১৯০২তে
এমারেল্ড থিয়েটারের দুই নাচ-বালিকা শশীমুখী ও ফণীবালার কন্ঠে দুটি গান রেকর্ড হল, সেটিই
এদেশের প্রথম বাংলা গানের ধ্বনিমুদ্রিকা বা গ্রামফোন রেকর্ড । কালো গালার চাকতিতে
ধ্বনিমুদ্রিত বাংলা গান গ্রামফোন যন্ত্রবাহিত হয়ে পৌছে গেল মধ্যবিত্ত বাঙালির
অন্দরমহলে ।
বিশ শতকের
সেই প্রথম দশকেও, বাংলার সমাজ অনেক শিক্ষিত, জাতীয়তাবাদ তীব্র হয়েছে তখনও গান
গাওয়াকে বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি । গান গাওয়াকে পেশা হিসাবে
গ্রহণ করাকে হীন বৃত্তি রূপেই মনে করা হত আর মেয়েদের গান করা তো ছিল তখনকার সমাজের
চোখে পাপ কাজ । অভিজাত পরিবারের সন্তান হিসাবে প্রথম গ্রমফোন রেকর্ডে গান করেন
লালচাঁদ বড়াল । যার পুত্র রাইচাদ বড়াল আধুনিক বাংলা গান ও সিনেমার গানের সুর রচনার ক্ষেত্রে
অন্যতম পথিকৃতের মান্যতা পেয়েছেন । লালচাঁদ বড়ালই গ্রামফোন রেকর্ডের প্রথম পুরুষ
গায়ক । তাঁর গানের রেকর্ডের লেবেলে এমেচার কথাটি লেখা থাকতো । রেকর্ডিং চালু হবার
পর ২৫/৩০ বছর
নীচের মহল থেকে উঠে আসা মেয়েরাই বিশেষত থিয়েটারের মেয়েরা বাংলার সঙ্গীত জগতকে
আলোকিত করেছিলেন । শিল্পীর মর্যাদায় এরা সঙ্গীত জগতে লিজেন্ড হয়ে আছেন । গহরজান, কৃষ্ণভামিনী, আশ্চর্যময়ী, হরিমতি, কমলা
ঝরিয়া, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা থেকে কানন দেবীরা বাংলা গানের ভুবনকে ঐশ্বর্যমন্ডিত
করে গেছেন ।
গ্রামফোন রেকর্ড
সম্পর্কে দুএকটি তথ্য জানিয়ে রাখি । একদম প্রথমে এদেশে ধ্বনি মুদ্রনের প্রযুক্তি
ছিল না । রেকর্ড প্রিন্ট হয়ে আসতো জার্মানীর হ্যানোভার লন্ডন, ফ্রান্স থেকে সেগুলি হত একটু বড় মাপের
এবং একদিকে একটি মাত্র গান থাকতো । অবশ্য পরবর্তী সময়ে আমাদের পরিচিত রেকর্ডের মত ৭৮ পাকই
ঘুরতো একটি গানের জন্য । ১৯৬২ নাগাদ এই ৭৮ ঘুরণের রেকর্ডের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, আসে
৪৫ ঘুরণের বর্ধিত বাদন বা এক্সটেন্ডেড প্লে যাতে দুপিটে চারটি গান থাকতো, এবং ৩৩
ঘুরণের দীর্ঘবাদন বা লংপ্লে রেকর্ড যাতে দু পিঠে ৮টি করে গান থাকতো । আশির দশকের
শুরুতে সেগুলির উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়, চলে আসে ক্যাসেট । বছর দশেকের মধ্যে ক্যাসেট
লুপ্ত হয়ে চলে আসে কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সিডি । অর্থাৎ তিনরকম প্রযুক্তিতে গানের
ধ্বনিমুদ্রন বন্দোবস্তের বয়স একশো বছরেরও কম ।
১৯০২এ বাংলা
রেকর্ডের গানের প্রচলন হলেও পরিশীলিত গায়নশৈলী, গানের কথায় আধুনিক কাব্যের ছোঁয়া
লাগতে এবং আমাদের গায়নরুচি তৈরি হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো ১৫/২০ বছর । তখনকার
বিনোদনের গানগুলি ছিল কীর্তনাঙ্গ, শ্যামা সঙ্গীত, দেহতত্ব, প্রেম ও ছলনামূলক চটুল
গান অথবা মোটা দাগের হাসির গান । ইতিমধ্যে অবশ্য শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকরা
রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছেন । তখন বলা হত ‘রবিবাবুর গান’। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নিজ কন্ঠে গান রেকর্ড
করেছিলেন ১৯০৮এ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালে পৌছে বাংলা গানের কথা, সুর ও
গায়নশৈলীতে লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন এলো । ইতিমধ্যে বাংলার সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রস্তুত
হয়েছিল আগেই । বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে স্বদেশী ভাবনার গান বাংলাকে উত্তাল করেছিল,
এসেছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথের
দেশাত্মবোধক গানের প্রবল জোয়ার । রবীন্দ্রনাথ পথে নেমেছেন, মঞ্চনাটকে গান গাইছেন, ক্ষুদিরাম
শহিদ হয়েছেন, বুড়িলামের যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন বিপ্লবী বাঘা যতীন, স্বদেশী ভাবনায়
উত্তাল পল্লীবাংলার পথে পথে অনামি চারণ
গান গেয়ে চলেছে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ । বাঙালি মননের ঊর্বর ভূমি অতয়েব প্রস্তুত । বাংলা গান প্রকৃত অর্থে আধুনিক হওয়ার প্রস্তুতি শুরু যেন শুরু হয়েছিল ।
বিশ শতকের
গোড়াতেও গান-বাজনাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করা হীনবৃত্তি মনেকরা হত, মেয়েদের সে কাজ
করা তো পাপ বলেই মনে করতো তখনকার সমাজ । পুরুষদের মধ্যে প্রথম রেকর্ডের গান
গেয়েছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান লালচাঁদ বড়াল ১৯০২তেই । এর ১০/১৫ বছরের
মধ্যে কলের গান বাঙালির ঘরে ঘরে পৌছাতে শুরু করলো । গ্রামফোন কোম্পানী বিজ্ঞাপন
করতো ‘সুখি গৃহকোণ শোভে গ্রামফোন’ । উঠে এলেন অনেক শিল্পী – কাসেম মল্লিক ১৯০৯, ইন্দুবালা ১৯১৬,
আঙ্গুরবালা ১৯১৬ এবং কৃষ্ণচন্দ্র দে ১৯১৭তে প্রথম গ্রামফোন রেকর্ডে গান গাইলেন ।
বিপণনযোগ্য বাংলা গানের সেইসব অগ্রপথিকদের কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না । তাদের
কয়েকজনের কথা বলে এই পর্ব শেষ করবো ।
লালচাঁদ
বড়াল : পরিবারে তার আগে কেউ সঙ্গীত
চর্চা করেননি, কিন্তু ছোট থাকেই গানের প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ আকর্ষণ । সঙ্গীত
সম্পর্কে পিতা নবীনচাঁদের কোন আগ্রহ ছিল না । তিনি চাননি যে ছেলে তাঁর সঙ্গীতচর্চা
করুক । কিন্তু মায়ের প্রস্রয় ছিল অথচ গ্রামফোনের গান গাওয়া শুরু হতেই তিনি গাইলেন
এবং তাঁর গানের লোকপ্রিয়তা রেকর্ড কোম্পানীকে অভাবনীয় ব্যবসায়িক সাফল্য এনে
দিয়েছিল । লালচাঁদের গাওয়া
গানগুলির মধ্যে ‘তুমি কাদের কুলের বউ’,
‘তোমার ভাল তোমাতে থাক’, ‘হৃদয়
রাসমন্দিরে’, ‘নবমী নিশি গো’, ‘আমারে আসতে বলে’
ইত্যাদি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল । সে যুগে সঙ্গীতকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার
মানসিকতা তৈরি হয়নি, হীন বৃত্তি বলেই মনে করা হত । লালচাঁদের গানের রেকর্ডে তাই
লেখা থাকতো ‘এমেচার’ ।
লালচাঁদের জন্ম ১৮৭০ সালে। তাঁর বাবা নবীনচাঁদ বড়াল ছিলেন
অ্যাটর্নি। পিতামহ প্রেমচাঁদও ছিলেন সেকালের গণ্যমান্য ব্যক্তি। গ্রামফোনের গানের যুগ শুরু হওয়ার পর মাত্র পাঁচ বছর গানের
জগতে ছিলেন লালচাঁদ । ১৯০৭ সালের ১৪ই মার্চ মাত্র ৩৭ বছর বয়সে গানের জগৎ থেকে চির
বিদায় নেন বিপণনযোগ্য বাংলা গানের এই অগ্রপথিক লালচাঁদ বড়াল ।
কে মল্লিক : প্রকৃত নাম মুন্সী মহম্মদ
কাসেম । তখনকার সমাজবাস্তবতার কারণে তাঁকে ছদ্মনাম নিতে হয় । ১৯০৯ সালে তাঁকে দিয়ে
১২য়ি শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ড করানো হয় । একজন মুসলমানের কন্ঠে শ্যামাসঙ্গীতের রেকর্ড
বিক্রয় হবে না ভেবে রেকর্ডগুলি প্রকাশিত হয় কে মল্লিক নামে । জন্ম ১৮৮৮’র ২৭শে মে
বর্ধমান জেলার কুসুম গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে । জীবিকার উদ্দেশ্যে কাসেম ১৯০২এ
কলকাতায় চলে আসেন এবং দোকান কর্মচারী হিসাবে জীবিকাজীবন শুরু করেন । পরে এক চামড়া
ব্যবসায়ীর কোম্পানি র্যালি বাদার্স’এর চাকরী নিয়ে কানপুরে চলে যান । কানপুর থেকে
কলকাতায় ফিরে ছোট ছোট হানের আসরে গান গেয়ে পরিচিতি লাভ করেন । তাঁর সু্মিষ্ট
কন্ঠস্বরের জন্য রেকর্ড কোম্পানীর নজরে পড়ে যান ।
কে মল্লিক ১৯০৯ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত বিভিন্ন সুরে বিচিত্র
ধরনের গান গেয়েছেন। শ্যামাসঙ্গীত ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদের গান রেকর্ড করেও
খ্যাতি অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার মাথা নত করে দাও হে,অতুলপ্রসাদের ‘বঁধু এমন বাদলে তুমি কোথায়’এবং নজরুলের ‘বাগিচায় বুলবুলি
তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’ গানগুলি রেকর্ড হলে সুধীমহলে প্রচন্ড লোকপ্রিয় হয় । উল্লেখ করি যে মুসলমান কন্ঠশিল্পী হিসাবে কে মল্লিকই
প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেন ।
১৯৫৯এ
মৃত্যু হয় আধুনিক বাংলা গানের প্রথম যুগের এই কিংবদন্তী শিল্পীর ।
ইন্দুবালা
:১৯১৬ সালে দুটি গান প্রকাশ
করে গ্রামফোন কোম্পানি, গান দু’টি ছিল ‘আশা
ফুরায়ে গেল’ ও ‘আর মুখে বলে কী হবে’। তারপর অর্ধ শতাব্দি ধরে গানের জগতে হয়ে উঠেছিলেন সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী । এক দিকে
খেয়াল, দাদরা, ঠুমরি কিংবা ভজন। অন্য দিকে নজরুলের গান, ভক্তিগীতি, নাটকের
গান কিংবা সিনেমার গান। একাধারে তিনি
সঙ্গীতশিল্পী আবার রঙ্গমঞ্চ ও সিনেমার অভিনেত্রী। তিনি ইন্দুবালা দেবী। ইন্দুবালার
জন্ম ১৮৯৯এর নভেম্বরে অমৃতসরে । মা রাজবালা ছিলেন মতিলাল বোসের সার্কাশের দলের
ট্রাপিজ খেলোয়াড় । ইন্দুবালার জন্মের পর রাজবালা সার্কাশ ছেড়ে দেন, মতিলা বোসের
সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় । কলকাতায় ফিরে এসে রাজবালা থিয়েটারে যোগ দেন এবং সফল
অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন । রাম বাগানের নিষিদ্ধ পল্লীতে বাড়তে থাকেন ইন্দু । প্রথমে
মায়ের কাছে সঙ্গীতশিক্ষা পান তারপরে বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে তালিম নেন ।
প্রবাদপ্রতীম গহরজানের কাছ থেকেও তালিম পেয়েছিলেন। রেকর্ডের গানে ইন্দু আকাশচুম্বী
লোকপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর গাওয়া নজরুলের ‘অঞ্জলি
লহ মোর সঙ্গীতে’, ‘আজ বাদল ঝরে’, ‘বউ কথা কও’, ‘মোর
ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ গানগুলি প্রভূত জনপ্রিয়তা পায় এবং
ইন্দুবালা হয়ে ওঠেন তাঁর সময়ে নজরুলের গানের সেরা গায়িকা । ১৯৭৫এ ইন্দুবালা পান ‘সঙ্গীত
নাটক আকাডেমি’ পুরষ্কার আর ১৯৭৬এ গ্রামফোন কোম্পানি তাঁকে সম্মানিত করেন তাঁর গানের ‘গোল্ডেন ডিস্ক’ প্রকাশ করে । গান ছাড়াও
পেশাদারী মঞ্চের নাটকে অভিনয় করেছেন এবং ৪৮টি ছায়াছবিতেও অভিনয় করেছেন ।
সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ইন্দুবালা খ্যাতির শিখরে
উঠেছিলেন, গ্রামোফোন কোম্পানীর ‘গোল্ডেন ডিস্ক’, ‘সঙ্গীত নাটক আকাডেমি সম্মাননা
পেয়েছেন । কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর
তাঁর পদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন ইন্দুবালা । দেশজোড়া খ্যাতি
সত্তেও তিনি রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লী ছেড়ে অন্যত্র চলে যান নি । বলতেন ‘আমি
রামবাগানের মেয়ে ... রামবাগানই তো আমায় সব কিছু দিয়েছে । অর্থ, সম্মান ভালোবাসা সব...’
। একদিকে দেশজোড়া খ্যাতির আলো আর অন্যদিকে
রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার । এই দুইএর মাঝেই সুরের আকাশে উজ্বল জ্যোতিষ্ক
ছিলেন ইন্দুবালা ।
কৃষ্ণচন্দ্র দে :শৈশবে মাত্র ১৩ বছর
বয়সে সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হয়ে আপন মেধা, নিষ্ঠা ও মানসিক শক্তি সম্বল করে অসামান্য
সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে গানের জগতে এসেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে । ভারতীয় সঙ্গীতে নিজেকে
দাঁড় করিয়েছিলেন এক অসামান্য উচ্চতায় । এই কিংবদন্তী শিল্পীর জন্ম ১৮৯৩এর অগস্ট
মাসে জন্মাষ্টমির দিন, পিতা শিবচন্দ্র ও মাতা রত্নমালা দেবী তাই নাম রেখেছিলেন
কৃষ্ণ । ১৯১৭তে প্রথম গানের রেকর্ড করার
পর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি । সঙ্গীতের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ ছিল
কৃষ্ণচন্দ্রের । উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিল্পী হলেও অসংখ্য কীর্তন ও কীর্তানাঙ্গের গান,
বাউল, ভাটিয়াকি ইত্যাদি লোক আঙ্গিকের গান, হিদি ও উর্দু গজল, থিয়েটারের গান ও
অন্যানবঅ গানে অবিস্মরণীয় সুরকার ও শিল্পী ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র । কয়েকটি
রবীন্দ্রনাথের গানও গেয়েছেন তিনি । তাঁর সুরারোপিত দেশাত্মবোধক গান ‘মুক্তির
মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান’, নাটকের গান ‘ওই মহাসিন্দুর ওপার হতে কি
সঙ্গীত ভেসে আসে’ আজও অবিস্মণীয় । কুমার শচিন দেববর্মনের প্রথম সঙ্গীত শিক্ষক
ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ।
গান গাওয়া ও সুর রচনা ছাড়াও কৃষ্ণচন্দ্র দাপটে অভিনয়
করেছেন চলচ্চিত্রে ও থিয়েটারে । বাংলায় খ্যাতির শিখরে থেকে ১৯৪২এ পাড়ি জমান
মুম্বাই । মুম্বাই চলচ্চিত্র শিল্পে অনেক ছায়াছবিতে সুর দিয়ে পেয়েছিলেন সর্বভারতীয়
খ্যাতি । পাঁচ বছর ছিলেন মুম্বাইতে । ১৯৪৭এ কলকাতায় ফিরে শুরু করেন বাংলা ছায়াছবির
প্রযোজনা ।
থিয়েটারের অভিনেত্রী ও গায়িকা তারকবালাকে স্ত্রীর
মর্যাদা দিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র, যদিও এই বিবাহের কোন পারবারিক স্বীকৃতি ছিল বলে
মনে হয় না । কৃষ্ণচন্দ্র তারকবালার জন্য একটা বাড়ি কিনে রেখেছিলেন । কৃষনচন্দ্রের
মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ তারকবালা সেই বাড়িতে উঠে যান । তাঁর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র মান্না
দে তাঁর আত্মকথন আমি ‘নিরালায় বসে’ গ্রন্থে ‘আমার কাকা’ অংশে কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কে
অনেক কথা লিখেছেন কিন্তু তার স্ত্রী তারকবালা সম্পর্কে একটি শব্দও লেখেননি । ১৯৬২’র
১৮ই নভেম্বর মৃত্যু হয় এই কিংবদন্তী শিল্পীর ।
গত শতকের গোড়াতে গ্রামফোন রেকর্ডের গানের প্রবর্তনের
পরের দুটি দশকের বাংলা গানের পথচলাকে বুঝতে চাইলাম এই পর্বে । বিশ শতকের গোড়াতেই
গান বাঙালির প্রাণের জিনিস হয়ে উঠেছিল । ১৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ বিলাত গিয়েছিলেন
পড়তে । বিলেত থেকে ফিরে
রচনা করলেন গীতিনাট্য ‘বাল্মিকী প্রতিভা’(১৮৮১) ও কালমৃগয়া’(১৮৮২) । নানা বিচিত্র ধারায়
তখন বাংলা গানের প্রকাশ, সৃষ্টি হচ্ছে বাংলা গানের সমৃদ্ধ ভান্ডার । রবীন্দ্রনাথের
সমকালেই এলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন ও রজনীকান্ত সেন । বাঙালি তার
গানের চিরকালীন ঐশ্বর্য খুঁজে পেল তাঁদের গানের মধ্যে । দ্বিজেন্দ্রলাল,অতুলপ্রসাদ,
রজনীকান্তর কথা বলব আগামী পর্বে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন