প্রাক-আধুনিক যুগের গান
রামপ্রসাদ তাঁর
সৃষ্টির মধ্যগগনে থাকাকালীন আরো আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে এলো ‘বাংলা টপ্পা গান’, প্রবর্তন
করলেন রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু (১৭৪২ – ১৮২৯) । বাংলা গান পৌছালো প্রাক-আধুনিক
যুগে ।
টপ্পা গানের উৎপত্তি
পাঞ্জাবে হলেও রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবুই বাংলায় টপ্পা গানের প্রচলন করেন । কাব্যছন্দ
আশ্রিত টপ্পা গান বাংলার নিজস্ব গান হয়ে ওঠে
– হয়ে ওঠে বাংলা কাব্য সঙ্গীতের দিক-দর্শনী । টপ্পা গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের
কথা – “এ তো অত্যন্ত বাঙালির গান
। বাঙালির ভাবপ্রবন হৃদয় অত্যন্ত তৃষিত হয়েই গান চেয়েছিল,
তাই সে আপন সহজ গান আপনি সৃষ্টি না পারেনি” (‘সঙ্গীত চিন্তা’) ।
রামনিধি
গুপ্ত (১৭৪১ -১৮৩৪)
বাংলায় টপ্পা গানের প্রবর্তক । উটচালকরা মরুভূমি পেরনোর
সময় যে ছন্দময় কোলাহল করতো তা থেকেই এই সঙ্গীতধারার উৎপত্তি । জন্ম ১৭৪১এ । পিতা হরিনারায়ণ
গুপ্ত, পৈত্রিক
নিবাস কলকাতার কুমারটুলি । নিধুবাবু কুড়ি বছর বয়সে কোম্পানীর চাকুরি নিয়ে কিছুকাল ছাপরায়
অতিবাহিত করেন । এখানে এক মুসলমান সঙ্গীত শিক্ষকের কাছে হিন্দুস্থানি টপ্পা গানের তালিম
নেন । ১৭৯৪তে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং বাংলা টপ্পা গান রচনা গায়নে
প্রবৃত্ত হন ।
নিধুবাবু প্রবর্তিত
টপ্পা গানেই প্রথম আধুনিক বাংলা কাব্যের ব্যক্তিক প্রণয়ের সুর প্রথম শোনা যায় । রাধা-কৃষ্ণের কথা বাদ দিয়েও যে বাংলায় প্রেমসঙ্গীত
রচনা করা যায় তা আমরা প্রথম দেখতে পাই নিধুবাবুর টপ্পা গানে । সেকালে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের
গৃহে সঙ্গীতের আসর বসতো তাতে নিধুবাবুর অংশগ্রহণ যেন অতি আবশ্যক ছিল । এখনো আমরা পুরাতনী
প্রণয় সঙ্গীত শুনতে চাই নিধুবাবুর গানের আশ্রয়ে । প্রণ্যসঙ্গীত ছাড়াও নিধুবাবুই স্বাদেশিক
গানের প্রথম সঙ্গীতকার তাঁর গানেই আমরা পেয়েছি ভাষা প্রেমের সেই প্রবাদপ্রতীম পংক্তি ‘বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা’ । টপ্পার গায়ন-পদ্ধতি এমনই যে, এর সুরের ভাঁজে ভাঁজে গায়কের ব্যক্তিত্ব
ফুটে ওঠে। টপ্পায় বাণীর চেয়ে রাগের কাজ বেশি। এর আলাপি ধরনের সুর শ্রোতার মনে মাদকতা
আনে। টপ্পাগানে আদিরসের স্থান থাকলেও নিধু গুপ্ত বিশুদ্ধ মানবীয় প্রেমের গান রচনা
করেন।
নিধু বাবুর অনেক গান
আধুনিক বাংলা লিরিকের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত । ১৮৩২ সালে গীতরত্ন নামে তাঁর গানের একটি সংকলন
প্রকাশিত হয়; তাতে
৯৬টি গান স্থান পায়। দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত আকর গ্রন্থ ‘বাঙ্গালীর গান’এ
(১৯০৫) নিধুবাবুর ৪৫০টি এবং সঙ্গীতরাগকল্পদ্রুম নামক সংকলনে ১৫০টি গান মুদ্রিত
হয়েছে ।
মধ্যযুগের আর একটি
আঞ্চলিক সঙ্গীত ধারা ‘আখড়াই
গান’ । শান্তিপুরে এই গানের উৎপত্তি
১৮ শতকের গোড়ায় , নিধুবাবুর
মাতুল কলুই চন্দ্র সেনকে বাংলায় আখড়াই গানের প্রবর্তক বলা হয় । আদতে ‘আখড়াই গান’
উত্তর ভারতের
‘আখাড়া গানে’র এক বিবর্তিত রূপ । সেই হিসাবে
‘আখড়াই’ অনেক প্রাচিন সঙ্গীত ধারা । বাংলাতে এসেও এই গান নানা ভাবে বিবর্তিত
হয়েছে । মালদহ। নদীয়া কিংবা হুগলীতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আখড়াই গান পরিবেশিত হত । শেষে
বাবু কলকাতায় এসে আখড়াই গান মার্জিত হয় কলুই চন্দ্র সেনের হাতে । এই গানের দুটি পর্যায়
থাকতো – ‘খেউড়’ ও
‘প্রভাতি’ । পরে এই গানেরই আর একটি রূপ
‘হাফ আখড়াই’ সৃষ্টি হয় , নিধু বাবুরই এক শিষ্য মোহন চাঁদ বসু উদ্ভাবন করেন ‘হাফ আখড়াই’। এই রীতির গানও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি,
কারণ ততদিনে এসে গেছে
‘পাচালি’ গান ও আরো আকর্ষণীয় ‘থিয়েটারের গান । ‘‘আখড়াই গান’ কবিগানেরই আর এক রূপ একথাও মনে করা হয়
কারণ কবি গানের চারটি পর্যায়ের দুটি পর্যায় ছিল
‘খেউড়’ ও প্রভাতি’ – আখড়াই গানেও তাই । অনেক গবেষক বলেন অস্লীল আদিরসাত্মক ‘খেউড়’
থেকেই কবিগানের উৎপত্তি । কবিগানের তিনটি মূল বৈশিষ্ট – সংলাপ ধর্মী গান অর্থাৎ গানের মধ্যে প্রশ্ন
ও উত্তর। খেউড়’ বা
অশ্লীলতার প্রয়োগ এবং হেঁয়ালি মূলক তত্বে্র প্রয়োগ । প্রায় গ্রাম্য মেয়েদের ‘ঝুমুর’ গানেও
প্রশ্নোত্তর মূলক গান থাকতো তবে তা নৃত্য সহযোগে
, তাই অনেক গবেষক মনে করেন
‘ঝুমুর’ থেকেই কবি গানের উৎপত্তি । এগুলি সবই আঞ্চলিক গানের বিভিন্ন রূপ মাত্র, নানান নানান রূপে বিবর্তিত হয়েছে- পরিমার্জিতও হয়েছে । প্রথমে ‘কবি গানে’
‘খেউড়’ বা অশ্লীলতার প্রয়োগ হত, আবার সেই কবিগানই নদীয়ায় বৈষ্ণব প্রভাবে গীত হত কৃষ্ণ উপাখ্যানকে বিষয়বস্তু
করে । কবিগানের বিবর্তনে ‘ঝুমুর’ গানের
প্রভাব ছিল এতে গবেষকদের কোন সংশয় নেই । অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ
পর্যন্ত কলকাতার বাবু সমাজে ‘কবি গান’ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল । রাম বসু,
হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, মাধব ময়রা,ভবানী বেনে প্রমুখ ছিলেন সেকালের প্রসিদ্ধ কবিয়াল । সেকালের বাবু সমাজের
জনরুচিতে আর একটি গানের ধারা বেশ কদর পেয়েছিল সেটা হল
‘গোপাল উড়ের গান’
।
গোপাল
উড়ে
গোপাল উড়ের গান সম্পর্কে ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’গ্রন্থে পন্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য
করেছেন “এই
সময় বিদ্যাসুন্দরাদি পালা যাত্রার দলে গীত হওয়ার জন্যকতকগুলি ললিত শব্দবহুল কদর্যভাবপূর্ণ
গান রচিত হইয়াছিল;এই
সকল গানের সসম্মতিক্রমে ওস্তাদ কবি গোপাল উড়ে;ইনি ভারতচন্দ্রের একবিন্দু ঘনরস তরল করিয়া এক শিশি প্রস্তুত করিয়াছেন”।
গোপালের জন্ম উড়িষ্যার কটক জেলার জাজপুরের এক দরিদ্র
কৃষক পরিবারে । পিতা মুকুন্দ করণের মধ্যম পুত্র গোপাল তরুণ বয়সে জীবিকার জন্য কলকাতায়
আসেন । কলকাতায় সুর করে হেঁকে ফল ফেরি করতেন । গোপালের সুমিষ্ট স্বরে আকৃষ্ট হয়ে বউবাজারের
রাধামোহন সরকার তাঁর যাত্রা দলে নিয়ে আসেন গোপালকে,
গোপালের সঙ্গীত শিক্ষার ব্যবস্থাও করেন । গোপাল রাধামোহনের
যাত্রা দলে নাচ গান ও অভনয়ে সেকালের নব্য বাবুসমাজকে মোহিত করেন । রাধা
মোহনের মৃত্যুর পর গোপাল নিকেই যাত্রার দল খোলেন এবং বিদ্যাসুন্দর পালা সহজ বাংলায়
হান বেঁধে নতুন ভাবে পরিবেশন করেন । সঙ্গীত গবেষক দুর্গাদাস লাহিড়ী তার আকর গ্রন্থ
বাঙ্গালির গান’এ
গোপাল উড়ের ২৩৯টি গান উদ্ধার করেছেন । মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে নিঃসন্তান গোপালের মৃত্যু
হয় । গোপালের গান সম্পর্কে পন্ডিত দীনেশচন্দ্র সেনের মন্তব্য “গোপাল উড়ের গানে যে ক্ষিপ্র গতি ও কবিত্ব
টের পাওয়া যায়, তাহাতে
মনে হয়যেন ভারতীর নূপুর সিঞ্জন শোনা যাইতেছে ।এককালে এই কবিদের গানে বঙ্গদেশের হাট, বাট ছাইয়া পড়িয়াছিল” (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য ২য় খন্ড) ।
এইসব স্থুল রুচির কবিগান কিংবা ‘বিদ্যাসুন্দর’এর গান সেকালের নব্য বাবু সমাজের প্রবল
পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল সত্য কিন্তু তা কোন স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেনি । তবুও স্বীকার
করতে ্গালিরেই গানগুলি বাঙালির সঙ্গীত পরম্পরায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়ে আছে । রবীন্দ্রনাথ
তাঁর ‘সঙ্গীতচিন্তা’ গ্রন্থে
‘কবিগান’কে ‘নষ্ট
পরমায়ু কবির দলের গান’ বলে
আখ্যায়িত করেও বলেছেন - “তথাপি
এই গান আমাদের সাহিত্য এবং ইতিহাসের একটি অঙ্গ
– এবং ইংরাজ রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ
করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক’ (সঙ্গীত চিন্তা) ।
রবীন্দ্রনাথের স্পর্শে বাংলা গান আধুনিক হবে, কিন্তু কি ছিল তার আবির্ভাব পূর্ববর্তি
বাংলা গান, কেমন
ছিলো বাঙালির গান শোনার কান ? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার সমাজে নতুন মধ্যশ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল
সেই মধ্য শ্রেণির ‘বাবু
কালচার’ বাঙ্গালির
রুচি বিকৃতি ঘটিয়েছিল , সে
কথা আমরা ‘হুতোম
প্যাঁচার নকশা’ বা ‘রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’ গ্রন্থে জেনেছি । তাদের রুচি তখন আদিরসাত্মক ‘কবিগান’
, ‘আখড়াই’, ‘হাফ আখড়াই’ , ‘ঝুমুর’ ‘তরজা’ ‘পাঁচালি’
ইত্যাদিতে । রবীন্দ্র নাথ যখন বাল্য বয়সে ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ রচনা করছেন,
দাদা জ্যোতিরীন্দ্র নাথের গান গাইছেন, শাস্ত্রীয় গায়নের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি প্রতিভা
যদুভট্টর কাছে তালিম নিচ্ছেন, বাঙালি সমাজ তখন মেতে আছেন সেই সব নিম্ন রুচির গানে । ‘কীর্তন’,
‘রামপ্রসাদী’, ‘টপ্পা’, দাশরথী
রায়ের ‘পাচালি’, এমনকি
‘আখড়াই’ গানের পরিশীলিত কাব্য ভাষা থেকে কলকাতার
‘নব্য বাবু সমাজ’
মেতেছিল নিম্নরুচির গানে তথাপি, বিদ্যাসুন্দর থেকে থিয়েটারের গান – বাংলা গানের এই যে ধারা, তা নিশ্চিত ভাবেই ‘জনপদের গান’,
‘কবিগান’কে ‘নষ্ট
পরমায়ু কবির দলের গান’ বলে
আখ্যায়িত করেও বলেছেন - “তথাপি
এই গান আমাদের সাহিত্য এবং ইতিহাসের একটি অঙ্গ
– এবং ইংরাজ রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ
করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক’ (সঙ্গীত চিন্তা) ।
প্রাক-আধুনিক পর্বের বাংলা গানের ধারায় সর্বাধিক উল্লখযোগ্য সংযোজন দাশরথী
রায়ের (১৮০৬-১৮৫৮)
‘পাঁচালি গান’ । দাশরথী রায়কে ‘পাচালি’র জনক না বলে এ গানের শ্রেষ্ঠ রূপকারই বলা উচিত । দাশরথী রায়ের অনেক
আগে থেকেই পল্লী বাংলার এবং উড়িষ্যার বৈষ্ণব সম্প্রদায় এ গান গাইতেন । পরে নব্য বাবু
সমাজের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ‘পাঁচালি’ গায়ন রীতি ও সুরে আধুনিকতার ছোয়া লাগে
, কৃষ্ণ উপাখ্যান থেকে রামায়ণ,
মহাভারত ও মঙ্গল কাব্য এ গানের বিষয় বস্তু হয় এবং কীর্তন, আখড়াই,
টপ্পা ও কবি গানের কিছু সংমিশ্রণ ঘটে । আধুনিক ‘পাচালি’গানের প্রথম রূপকার ছিলেন লক্ষীকান্ত বিশ্বাস । আনুমানিক ১৮২০তে লক্ষীকান্তর
মৃত্যু হয়, দাশরথী
রায় তখন কিশোর । লক্ষীকান্ত বিশ্বাসের পর শুরু হয় দাশরথী রায়ের পাঁচালির যুগ ।
দাশরথি
রায় (১৮০৬ – ১৮৫৭)
প্রাক-আধুনিক পর্বের বাংলা গানের ধারায় সর্বাধিক
উল্লখযোগ্য সংযোজন দাশরথি রায়ের (১৮০৬-১৮৫৮) ‘পাঁচালি গান’ । দাশরথি রায়কে ‘পাচালি’র
জনক না বলে এ গানের শ্রেষ্ঠ রূপকারই বলা উচিত । দাশরথি রায়ের অনেক আগে থেকেই পল্লী
বাংলার এবং উড়িষ্যার বৈষ্ণব সম্প্রদায় এ গান গাইতেন । পরে নব্য বাবু সমাজের
মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ‘পাঁচালি’ গায়ন রীতি ও সুরে আধুনিকতার ছোয়া লাগে , কৃষ্ণ
উপাখ্যান থেকে রামায়ণ, মহাভারত ও মঙ্গল কাব্য এ গানের বিষয় বস্তু হয় এবং কীর্তন, আখড়াই,
টপ্পা ও কবি গানের কিছু সংমিশ্রণ ঘটে । আধুনিক ‘পাচালি’গানের প্রথম রূপকার ছিলেন
লক্ষীকান্ত বিশ্বাস । আনুমানিক ১৮২০তে লক্ষীকান্তর মৃত্যু হয়, দাশরথি রায় তখন
কিশোর ।
দাশরথি রায়ের জন্ম বর্ধমান জেলার কাটোয়ার
বাঁধমুড়ি গ্রামে । পিতা দেবীপ্রসাদ রায় । ছড়া ও পদ্য রচনায় তাঁর স্বাভাবিক প্রতিভা
ছিল । তখন বাংলায় কবিগান খুব লোকপ্রিয় ছিল । নব্য বাবু সমাজের কাছে স্থুল রুচির
কবি গান খুব উপভোগ্য ছিল । আত্মীয় পরিজনদের নিষেধ
উপেক্ষা করে দাশরথি কবির দলে যোগ দেন । এক কবি গানের আসরে প্রতিপক্ষের
কবিয়ালের স্থুল রুচির আক্রমণে অপমানিত বোধ করে কবির দল ত্যাগ করেন । ১৮৩৬ সনে
দাশরথি পাঁচালি গানের আখড়া প্রতিষ্ঠা করে পাঁচালি গানের নতুন বিন্যাস করে লোকপ্রিয়
করে তোলেন । নবদ্বীপের প্নডিত সমাজ তাঁর পাঁচালি গানের প্রসংশা করেন । তিনি শুধু
পুরাণাশ্রিত ধর্ম ভক্তি রসের পাচালি সঙ্গীত রচনা করেননি, অলঙ্কারযোগে
ছড়ার চটুল ছন্দের ঝংকার,সঙ্গীতের সুরেলা মাধুর্য এবং রঙ্গ-ব্যঙ্গরস যুক্ত করে পাঁচালিকে বিভিন্ন শ্রেণির
শ্রোতাদের উপভোগ্য করে তোলেন, ধর্ম,সমাজ,নীতিশিক্ষা,রঙ্গ-কৌতুক,শ্লীল-অশ্লীল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে
তিনি গান রচনা করে নিজেই পরিবেশন করতেন। তাঁর গানগুলি রাগসুরে রচিত এবং তাতে টপ্পা অঙ্গের ব্যবহার হত ।
দাশরথি রায় বিভিন্নবিষয়ক ৬৪টি পালায় প্রায় ৬৭৫টি গান রচনা করেন। সেগুলি সংকলিত ও
সম্পাদিত হয়ে ১৯৫৭ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।
১৮৫৮তে ‘পাঁচালি’ গানের শ্রেষ্ঠ রুপকার দাশরথী
রায়ের মৃত্যু আর তার তিন বছর পরে রবীন্দ্র নাথের জন্ম । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ।
ইতিমধ্যে দেশাত্মবোধের বিকাশ শুরু হয়েছে, মধ্যবিত্ত বাঙালির জনরুচিতে পরিবর্তন
স্পষ্ট হচ্ছে । রামনারায়ণ তর্করত্ন সমাজ সংস্কারমূলক নাটক লিখলেন ‘কুলীন কুল
সর্বস্ব’ (১৮৫৮), নাট্যক্ষেত্রে প্রবল আবির্ভাব হল মাইকেল মধুসূদন দত্তর । বাংলা গানের মুক্তির প্রস্তুতিতে আরো একটি সুদূর
প্রসারী প্রভাব ফেলেছিল, সেটি হল থিয়েটারের গান । থিয়েটারের গানের কথা আগামী পর্বে
।
(আগামী
পর্বে ‘থিয়েটারের গান’)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন