পা বাড়ালেই ঘাটশিলা

 পা বাড়ালেই ঘাটশিলা

কম বয়সে শুনতাম বাঙালির হাওয়া বদলের একটা সেরা যায়গা নাকি ঘাটশিলাএকটু বড় হয়ে তখন পথের পাঁচালি, চাঁদের পাহাড়,আরণ্যক পড়ে ফেলেছি জেনে ছিলাম ঘাটশিলায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন । রেলের চাকরীতে বত্রিশ বছর মধ্য প্রদেশ বা এখনকার ছত্তিশগড়ে কাটিয়েছি । কতবার যে ছোট্ট ঘাটশিলা স্টেশন পেরিয়ে হুহু করে বোম্বে মেলে ছুটেছি ! কিন্তু সেতো গভীর রাত্রে । যখন বোম্বাই এক্সপ্রেসে বাড়ি আসতাম, দিনের বেলায় পেরোতাম ঘাটশিলা । তখন বাইশ-তেইশ বছর বয়স, ঘরে ফেরার আনন্দ ! ট্রেনের কামরার জানালা দিয়ে গাছপালা ঘেরা ছোট্ট ঘাটশিলা স্টেশনের টিকিট ঘরটা দেখতাম আর মনে মনে কল্পনা করে নিতাম, ঐ আশে পাশে কোথাও বা হবে অপু-দূর্গার সৃষ্টিকর্তার বাড়িটা সে অনেক দিন আগেকার কথা। পঞ্চাশ বছ আগের ।

নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতায় ঘাটশিলা এসেছিল এইভাবে – (দুটি স্তবক দিলাম)

“ঘাটশিলাঘটশিলা

কলকাতা ছেড়ে বল ঘাটশিলা কে যায় মিছাই

চিরদিন কলকাতা থাকি আমি, ঘাটশিলা ছাই। ...

একদিন তারপরবহুদিন পরে

অনেক অসাধ অনিচ্ছায় ঘাটশিলা চলিলাম

ঘাটশিলা দেখিলাম হায় ...”

জীবনানন্দ অরণ্যঘেরা গাছ-গাছালির ঘাটশীলার স্মৃতির কোন লেখাজোখা রেখে গেছেন কিনা জানি না । তবে ভ্রমণ সাহিত্যের পথিকৃত প্রবোধ কুমার সান্যালকে ঘাটশিলায় টেনে আনতে চেয়েছিলেন বিভুতি ভূষণ । বলেছিলেন, ‘ঘাটশিলায় চলে এসো । ওই ঢাকুরিয়াতে থাকলে স্বাস্থ্য টিকবে না’ ।

যাওয়া হয়নি এতোদিন এবার গেলাম । হাওড়া থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার ট্রেন যাত্রা । চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার বইএ পড়া জঙ্গল ঘেরা ঘাটশিলার সঙ্গে এখনকার  ঘাটশিলাকে মেলাতে পারলাম না  । না মেলাটাই স্বাভাবিক । নগরায়নের দস্তুর তো মানতেই হবে । বন কেটে বসত । ওভার ব্রীজ হয়েছে, ডিজেলের ধোঁয়া ছড়িয়ে অটো , ট্রেকার ছুটছে ।  এক মাইল দূরে বিশ্বের দ্বিতীয় গভীরতম তামার খনি ‘হিন্দুস্থান কপার’ অনেকটা শহুরে সৌন্দর্য এনে দিয়েছে মাত্র ৩১০০ বর্গ কিলোমিটারের একদা ধলভুম’রাজ্যের রাজধানী ঘাটশিলার ।

রাজা জগন্নাথ প্রতিষ্ঠিত আদিবাসীদের দেবতা গালুডির ‘রিঙ্কিনী মন্দির’ আর তার আসেপাশের জঙ্গল ঘেরা নৈসর্গ-শোভা কিংবা যদুগোড়ায় পাহাড়ী ঝর্ণার জল বাঁধ দিয়ে ধরে রাখা ‘বুরুডি ড্যাম’ ভ্রমণার্থীদের টানে বটে, কিন্তু আমার আকর্ষণ ছিল ছোট্ট ঘাটশিলার ‘গৌরীকুঞ্জ’তে পা রাখা এখানেই বিভুতিভূষণ থাকতেন । গৌরী তাঁর প্রথম স্ত্রী । তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল মাত্র এক বছরের । গৌরীর মৃত্যুর কুড়ি বছর পরে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন । পুত্র তারাদাস তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান । মাত্র একবছর দাম্পত্যজীবন কাটানো গৌরি দেবীর নামেই বিভূতিভূষণ তাঁর বাসার নামকরণ করেছিলেন ‘গৌরীকুঞ্জ’ । বাড়িটারও একটা কাহিনী আছে , বিভূতি ভূষণ নিজে বাড়িটা বানান নি । ‘ইছামতী’র সন্তান ‘সুবর্ণরেখা’র কুলে পাকাপাকি ভাবে আস্তানা করবেন – এও কল্পনা করেন নি । কোন এক বন্ধু তাঁর কাছে কয়েকশ’ টাকা ধার নিয়ে আর শোধ করতে পারেন নি । সে ভদ্রলোক শিক্ষাব্রতী ছিলেন । গালুডি ঘাটশিলা অঞ্চলের আরণ্যক শ্রীর প্রতি বিভূতির আকর্ষণ লক্ষ্য করে বন্ধুটি জোর করেই নিজের ঘাটশিলার বাড়িটি বিভূতিকে গছিয়ে নিজেকে আর্থিক ঋণ থেকে মুক্ত করেছিলেন । একজন বৃদ্ধ কেয়ারটেকার থাকেন বাড়িটা দেখাশোনা করার জন্য । তাঁর কাছেই বিভিতিভুষণের শেষ জীবনের দুএকটা কথাও শুনলাম । গৌরীকুঞ্জেই বিভুতিভূষণের মৃত্যু হয় ১লা নভেম্বর ১০৫০এ । গৌরীকুঞ্জে নেই কোন সংগ্রহশালা বা বিভুতিভুষণের ব্যবহৃত বস্তু বা লেখার সরঞ্জাম তবু এক অপরূপ তৃপ্তি আমার সঙ্গে থাকলো । যে মাটিতে, যে মাটির ঘাসে পথের পাঁচালি – অপরাজিত-আরণ্যকের স্রষ্টার পায়ের চিহ্ন আছে, যে বনানীর অমোঘ আমন্ত্রণে বনপথে হেঁটে বেড়াতেন,  সেই মাটি আর ঘাস আমিও স্পর্শ করলাম, এটা কি কম পাওয়া !

‘গৌরীকুঞ্জ’র কাছেই বেশ পরিচ্ছন্ন পরিবেশে অনেকটা যায়গা নিয়ে  রয়েছে ‘বিভূতি স্মৃতি সংসদ’ । এদের সঞ্চালক আক্ষেপ করলেন, ‘আপনাদের ওখানেতো বিভূতিভূষণের স্মৃতি রক্ষার কোন আয়োজনই নেই’ । সত্যি নেই বা আছে কিনা  আমি ঠিক জানি না । কিন্তু ঘাটশিলার কিছু মানুষের আন্তরিকতা রয়েছে এই সত্যিটা অন্তত জানা হ’ল ঘাটশিলা গিয়ে । স্মৃতি সংসদ কক্ষে এরা একটা ছোটদের ছবি আঁকার স্কুল চালায় গান, কবিতার অনুষ্ঠানও হয় । সামনের মাঠে বিভূতিভূষণের আবক্ষ প্রস্তর মূর্তি । আর একটি কক্ষে তাঁর কয়েকটি ছবি ও কিছু কথা । এখানে একটা ছবি দেখলাম গৌরী কুঞ্জের উঠোনে শববাহী শয্যায় শায়িত কথাশিল্পী আর শয্যা স্পর্শ করে বসে আছেন শিশুপুত্র তারাদাস ও অন্যান্যরা । এই ছবিটা অন্যকোথাও আমি দেখিনি । লোকালয় থেকে বেশি দূরে নয়, কিন্তু আসেপাশের শান্ত পরিবেশ সময়কে কেড়ে নেয়স্মৃতি সংসদের পরিচ্ছন্ন বারান্দায় বা সামনের মাঠে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় সব কাজ দূরে সরিয়ে রেখে । সময় দুর্বার গতিতে ধেয়ে চলেছে । এখনতো কোন অপু-দূর্গা কাশ বনের ফাঁক দিয়ে রেলগাড়ি ছোটা দেখে না । তবুও মানুষ – কিছু মানুষ কোননা কোন ভাবে অতীতকে ধরে রাখতে চায়, ধরে রাখেবিভূতিভূষণের ঘাটশিলা অন্তত তাঁকে ভুলে যায় নি ।

তরুণ বয়সে ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমাটা দেখেছিলাম । সেই প্রথম ‘সুবর্ণরেখা’নামটা শুনেছিলাম । আর এখানে চাক্ষুষ দেখলাম ‘সুবর্ণরেখা’ আর তার জলধারা । লোকপ্রবাদ, এ নদীর ঘাটে নাকি সোনা মেলে তাই এই নাম । আর সুবর্নরেখার ঘাটে শিলা তাই নাম ঘাটশিলা । লোককথা তার যায়গায় থাকুক । কিন্তু সত্য যেটা দেখার, তা হ’ল ছোট বড় অজস্র উপলখন্ডের বাধা পেরিয়ে বয়ে চলেছে রাঁচির কাছে ‘নাগিরি’ থেকে উৎপন্ন পূর্ব সিংভুম জেলা, পশ্চিম মেদিনীপুর,বালাসোর,তালসারি ছুঁয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়া ৩৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ জলধারা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র প্রবহমান ভাগীরথির তীরে দাঁড়িয়ে নিজের কাছেই যেন জানতে চেয়েছিলেন ‘নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো ?’ ঘাটশিলায় সুবর্নরেখার প্রসস্ত ঘাট এড়িয়ে উপলখন্ডে বসে সুবর্ণরেখার ধারা স্পর্শ করার কিংবা তাকে ছুঁয়ে দুদন্ড বসে থাকার যে কাব্যিক অনুভুতি তাকে প্রকাশ করি কেমন করে ?

ঘাটশিলা গালুডির আসেপাশে জঙ্গলে সকালে হেঁটে বেড়ালে অরণ্য যে কিভাবে অনুভুতির তন্ত্রী স্পর্শ করে আত্মমগ্ন করে দেয় তার হদিস কে দেবে ! নিজেকেই বলতে ইচ্ছে হয় ‘ ঐ সন্ধ্যা- তারার মত রহস্যের মধ্যে, বনপুষ্পের সুবাস ও বনকাকলির মধ্যে আমায় তোমার খেলার সঙ্গী করে রেখো যুগ যুগ । তুমি আপন মনে বিশ্বের বনতলে নবীন কিশোর সেজে বনফুলের মালা গলায় উদাসী হয়ে বেড়াও । সবাই ধন,জন,মান,যশ নিয়ে ব্যস্ত । কে দেখছে এই জ্যোৎস্নাময়ী নিশার অপূর্ব মন-মাতান শোভা ? আমার দেখার চোখ দিও জন্মে জন্মে । বারবার আসতে যেতে কোন আপত্তি নেই আমার – তবে তুমি মহাশিল্পী,তোমার প্রসাদ যেন জন্ম জন্ম লাভ করি – এই চোখ নিয়ে যেন আেই” । এ বর্ণনা আমার নয় । শখের জঙ্গল দেখা শহুরে আমি এ ভাষা পাবো কোথায় ! অরণ্যশিল্পী বিভূতিভূষণ একাত্তর বছর আগে তার দিনলিপিতে লিখে গেছেন তাঁর অনুভুতি । দিনলিপির তারিখ ১৭ই মে ১৯৪৩ । [গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য’র ‘অপুর পাঁচালী’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত] সময়ের স্রোতে বদলে গেছে অনেক কিছু এই সত্তর বছরে । অরণ্যের অধিকার বেহাত হয়ে চলেছে, মাটিতে কোদাল-গাইতির শব্দ,তামা আর ইউরেনিয়াম খণির বর্জ্য বুকে ধারণ করছে সুবর্ণরেখা । তবু এখনও লোকালর পেরিয়ে অরণ্যের অমোঘ আমন্ত্রণ । লোকালয় পেরিয়ে শাল-মহুয়ার জঙ্গল, গালুডির সবুজ নির্জনতা, ফুলডুংরি টিলা থেকে সূর্যাস্ত দেখা, শাল-মহুয়া-আমলকির জঙ্গল পেরিয়ে আদিবাসী জনজীবন আর লালমাটির সোঁদা গন্ধতো তেমনই আছে । তাইতো আজও প্রকৃতি এই অনিন্দ্য আয়োজন বারে বারে ডাক পাঠায় আর নির্জনতা প্রেমি জীবনানদের কবিতার পংক্তির মত ভ্রমণ-পিয়াসী মন বলে ওঠে –

“অনেক অসাধ অনিচ্ছায় ঘাটশিলা চলিলাম

ঘাটশিলা দেখিলাম হায় ...”

 

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ১৬

  অন্য ধারার গান : গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী     গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীতধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কা...