বাংলা গানের সেকাল-একাল দ্বিতীয় পর্ব

বাঙালির প্রথম গান – কীর্তন


‘কীর্তন হচ্ছে রত্নমালা রূপসীর গলায়’ – রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য দিয়েই শুরু করি ।

    কীর্তন বাংলার আদি গান, বাঙালির নিজস্ব সঙ্গীতধারা । এমনকি কীর্তন গানের সঙ্গে যে যন্ত্রের ব্যবহার হয় সেই মৃদঙ্গ ও করতাল একান্তভাবেই বাংলার । কীর্তন শব্দটির সাধারণ অর্থ বর্ণনা বা কথন। তবে সঙ্গীতের আলোচনায় কীর্তন শব্দটির বিশেষ অর্থ ও তাৎপর্য আছে । শ্রীমদ্ভাগবতে একটি শ্লোক এই অর্থের ইঙ্গিত আছে । পীতবাস পরিহিত কৃষ্ণ বেণু বাজাতে বাজাতে নিজ লীলাভূমি বৃন্দাবনে প্রবেশ করলেন তখন তখন গোপগণ চারিদিকে তাঁর কীর্তিগান করছিল । অর্থাত শ্রীকৃষ্ণের কীর্তিগানই কীর্তন ।

     চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে প্রবল ভক্তিরসে মথিত হয়েছিল বাংলা । সেই সময়কালকে বাংলার প্রথম নবজাগরণ বলা হয় । চৈতন্যদের বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের প্রবর্তক । যদিও বাংলায় ভক্তিবাদের প্রচার চৈতন্য-পূর্ব ঘটনা । দ্বাদশ শতকে জয়দেবের গীতগোবিন্দ, চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় সৃষ্টি হয়েছিল চৈতন্য আবির্ভাবের পূর্বে শ্রীচৈতন্যের চরিতকাররা বলেন চৈতন্যদেবই কীর্তন গানের স্রষ্টা। চৈতন্যের আবির্ভাবের পূর্বেও কীর্তন গানের প্রচলন ছিল কিন্তু ভক্তি-সাধন পদ্ধতি হিসাবে কীর্তনের বিশিষ্ট রূপ ও পরিণতি শ্রী চৈতন্যদেবের প্রভাবে

    ধারনাগতভাবে কীর্তন আদতে লোকসঙ্গীত বিশেষ একটি অঞ্চলের পল্লীগীতি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের মাধ্যমে অনুশীলন ও পরিশীলনের মধ্য দিয়ে শিল্পসঙ্গীতের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে । বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত ও লোকসাহিত্য গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন “কীর্তনের শিল্পসম্মত রূপ বাংলার লোকসঙ্গীতকে নানাভাবে প্রভাবিত করিয়াছে । পল্লীগীতির সাধারণ সুরের স্তর হইতেই ইহার উদ্ভব হইয়াছে” । চৈতন্য দেবের মৃত্যুর পর ১৫৮২ খৃস্টাব্দে নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রবর্তন করেন ‘কীর্তন’ গানের । সমকালে মুঘল সম্রাট আকবর বাদশার দরবারে, মিয়া তানসেন উজ্বলতম রত্ন রূপে বিরাজমান ।  শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে কীর্তন গানের কোন শিকড় নেই, সেই কারণেই ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে কীর্তন গানের কোন উল্লেখ নেই । ‘সঙ্গীত চিন্তা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন”আত্মপ্রকাশের জন্য বাঙালি স্বভাবতই গানকে অত্যন্ত করে চেয়েছে । সেই কারণে সর্বসাধারণে হিন্দুস্থানী সংগীতরীতির একান্ত অনুগত হতে পারেনি । সেই জন্যই ...... বহুমূল্য  গীতোপকরণ থাকা সত্বেও  বাঙ্গালিকে কীর্তন সৃষ্টি করতে হয়েছে । গানকে ভালোবেসেছে বলেই সে গানকে আদর করে আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করতে চেয়েছে”

    শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা অবলম্বনে যে কীর্তন গান গীত হয় তাকে বলা হয় লীলাকীর্তন । চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখের মহাজন পদাবলী লীলাকীর্তনের রসবস্তুকে ৬৪ প্রকার রসে বিন্যস্ত করেছেন যেমন জন্মলীলা, বাল্যলীলা, গোষ্ঠলীলা, পূর্বরাগ, অভিসার, রাসলীলা, কুঞ্জভঙ্গ, মানভঞ্জন, মাথুর, ঝুলন, বসন্ত, হোরি ইত্যাদি । এক একটি রসের বিভিন্ন মহাজন পদের সমাবেশে সেই রসের পালা সাজিয়ে কীর্তন গান গীত হয় যাকে বলি পালা গান বা পালা কীর্তন । শ্রী গৌরাঙ্গদেব কীর্তনের জনক, তাই প্রত্যেক পালা গানের পূর্ব গৌরাঙ্গদেব বিষয়ক একটি পদ গাওয়া হয় যাকে বলা হয় ‘গৌরচন্দ্রিকা’ । গৌরচন্দ্রিকা ভিন্ন পালাকীর্তন গীত হয় না ।

    আধুনিকতার ছোঁয়ায় মধ্যযুগের অধিকাংশ সঙ্গীতধারা অবলুপ্তি হয়েছে কিন্তু বাঙালির আদি গান কীর্তন চিরকালীন গানের মর্যাদা পেয়েছে । অতিক্রান্ত পাঁচশো বছরের সঙ্গীত পরম্পরায় কীর্তনের সুর আজও অমলিন, বাঙালি কোনদিন কীর্তনের সুর থেকে সরে যায়নি ।

    রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য গানে বাণীর সঙ্গে কীর্তনের সুরের সার্থক প্রয়োগ করেছেন । তিনি বারংবার কীর্তনের সুরের কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেনরবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তায় কীর্তন বিশিষ্ট মর্যাদায় আসীন । ‘সংগীতচিন্তা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ? “কীর্তনে জীবনের রসলীলার সঙ্গে সংগীতের রসলীলা ঘনিষ্ঠভাবে সম্মিলিত । জীবনের লীলা নদীর স্রোতের মতো নতুন নতুন বাঁকে বাঁকে বিচিত্র । ডোবা বা পুকুরের মতো একটি ঘের-দেওয়া পাড় দিয়ে বাঁধা নয় । কীর্তনে এই বিচিত্র বাঁকা ধারার পরিবর্ত্যমান ক্রমিকতাকে কথায় ও সুরে মিলিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছিল” ।

    গত শতকে গান বিপণন সামগ্রী হয়ে ওঠার পর অর্থাৎ কলেরগান ও গ্রামফোন রেকর্ডের চল হবার পর বাঙালির ঘরে ঘরে কীর্তন গান পৌছে গিয়েছিল । গ্রামফোন রেকর্ডে কীর্তন গানের প্রথম সার্থক শিল্পী ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে । তারপর রথীন কুমার ঘোষ, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধারাণী দেবী থেকে আজকের অদিতি মুন্সী পর্যন্ত অসংখ্য শিল্পী কীর্তন গানে বাঙালির সংগীতভান্ডারকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছেন ।  

আগমনি গান

   কীর্তনের মত আগমনিও বাংলার আপন গান । আগমনি গানের একটা উপলক্ষ্য আছে, তা হল শারোৎসবের প্রাক্কালে পার্বতীর মাতৃগৃহে আগমন উপলক্ষ্যে আগমনি গাওয়া হয় । শরৎকালে দুর্গাপূজার সময় গিরিরাজকন্যা পার্বতীর পিতৃগৃহে আগমন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আগমনি গান রচিত হয় । আগমনি গানের ক্ষেত্রটিওধিকার করে আছে হর-পার্বতী । কিন্তু আগমনি ধর্মসঙ্গীত নয় । এ গানের মধ্য দিয়ে বাঙালির চিরন্তন বাৎসল্য রসের বিকাশ হয়েছে । আগমনি গানে বাৎসল্য ও করুণরসের অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। এ গানের বিষয়বস্ত্ত পল্লীবাংলার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আগমনি গানের মধ্য দিয়ে বাঙালির ঘরের কথা, তার গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং বাস্তবতার এক নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায় এসব গানে। বাঙালি পরিবারের কন্যা ও জামাতাগৃহের বিরোধের কথাও এতে সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে । আগমনি গানের অনুপ্রেরণা এসেছে বৈষ্ণব গীতি কবিতা থেকে । তবে বৈষ্ণব কবিতায় থাকে ব্যক্তিগত অনুভুতির প্রাধান্য আর আগমনি গানে থাকে সার্বজনীনতার সুর । এই প্রসঙ্গে পন্ডিত দীনেশচন্দ্র সেনের উক্তি স্মরণ করি । ‘বৃহৎবঙ্গ’ পন্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন “বাংলার অন্তঃপুরের মর্মোক্তি ও বাঙালি জীবনের নিগূঢ ভাবের প্রস্রবন হইতে এই আগমনি গানের ধারা বহিয়া আসিয়া শিব সমাধির স্বর্গলোক স্পর্শ করিয়াছে । যাঁহারা আগমনি গান বুঝেন নাই, তাঁহাদের পক্ষে বাংলা দেশের অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস বুঝিতে বিলম্ব হইবে” ,

আগমনি গানের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন রামপ্রসাদ সেন । রামপ্রসাদ সেনে্র আগমনি গান সম্পর্কে পন্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বৃহৎ বঙ্গগ্রন্থে মন্তব্য করেছেন রামপ্রসাদের সুরে লক্ষ লক্ষ বিপন্ন সন্তানের ডাক মূর্ত হইয়া উঠিয়াছে সমস্ত বাংলা দেশ তাঁহার গানে সাড়া দিয়াছে পবর্তী সময়ে আরো যাঁরা এ গান রচনায় বাংলার সঙ্গীতভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (আনু. ১৭৭২-১৮২১), রামবসু (১৭৮৬-১৮২৮)   দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭) প্রমুখ

প্রাক-আধুনিক যুগ বা মুঘল যুগের শেষ পর্বে বাংলা কাব্য সঙ্গীতে আবির্ভাব হয়েছিল রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র (১৭১০-১৭৬১) ও রামপ্রসাদ সেনের (১৭২১-১৭৮১) । প্রায় সমকালেই সৃষ্ট হয়েছিল হরু ঠাকুর (১৭৩৯) প্রবর্তিত ‘কবিগান’ অষ্টাদশ শতকে বাংলা গানে আধুনিক কাব্য সঙ্গীতের ছন্দময়তা প্রথম আসে রামপ্রসাদ সেনের শ্যামা বিষয়ক গানে । এঁদের কথা বলা যাবে আগামী পর্বে।

(আগামী পর্বে ‘মধ্য যুগের গান’ )

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ১৬

  অন্য ধারার গান : গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী     গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীতধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কা...